মুর্শিদাবাদ জেলার কাগ্রাম গ্রামে জগদ্ধাত্রী-পুজোর উৎসব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 1 d ago
কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী মা
কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী মা
 
শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ 

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুরের কাগ্রাম গ্রাম এক অনন্য ঐতিহ্যের সাক্ষী। বহু যুগ ধরে এখানে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে একসঙ্গে বসবাস করে আসছেন। এই গ্রামে ধর্ম নয়, মানুষই মানুষের কাছে বড় পরিচয়। আর এই মিলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে এখানকার শ্রেষ্ঠ উৎসব, জগদ্ধাত্রী পুজো। বছর ঘুরে পুজো এলেই কাগ্রাম জেগে ওঠে আলো, রঙ আর ঢাকের আওয়াজে।
 
এই পুজোয় শুধু হিন্দুরাই নয়, গ্রামের মুসলিমরাও সমানভাবে অংশ নেন। কেউ প্যান্ডেল সাজানোর কাজে হাত লাগান, কেউ আলো লাগানোর দায়িত্ব নেন, কেউ আবার প্রতিমা দর্শনে পরিবার নিয়ে আসেন। ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সবাই মিলে উৎসবটিকে করে তোলেন এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক। কাগ্রামের এই ঐক্যই আজও বাংলার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
 
গ্রামে একাধিক সর্বজনীন পুজোর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি পারিবারিক পুজোও হয়। পুরনো প্রথা মেনে অনেক পুজোতেই আজও মহিষ ও ছাগ বলির রীতি চলে আসছে। বলি নিয়ে মতভেদ থাকলেও, এই রীতিই গ্রামবাসীর কাছে ঐতিহ্যের অংশ। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, “আমাদের পুজো শুধু দেবীর আরাধনা নয়, আমাদের মিলনের উৎসবও।” সেই মিলনের টানে আশপাশের গ্রামের মানুষও এই পুজোয় যোগ দিতে আসেন। ফলে কাগ্রাম জগদ্ধাত্রী পুজো এখন এক বৃহৎ উৎসবে পরিণত হয়েছে।
 
স্থানীয়রা জানান, উৎসবের সময় পুরো গ্রামটাই যেন এক পরিবারের মতো হয়ে যায়। পুজোর প্রস্তুতি থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত সবাই মিলে কাজ করেন। ঢাকিদের সঙ্গে তাল মেলান গ্রামের মুসলিম তরুণরাও। নারীরা একসঙ্গে প্রসাদ তৈরি করেন, শিশুরা আনন্দে মেতে ওঠে মেলায়। কাগ্রামের পুজো তাই শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সমাজের মেলবন্ধনের প্রতীক।
 
মুর্শিদাবাদ জেলায় হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানের বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। এক সময় নবাবদের রাজত্বকাল থেকে এই অঞ্চলে শিল্প, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐক্যের চর্চা হয়েছে। আজও কাগ্রামের মতো গ্রাম সেই ঐতিহ্যের ধারক। এখানে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের জায়গা নেই, বরং একে অপরের উৎসব ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই মানুষ খুঁজে নেয় আনন্দ।
 
গ্রামের প্রায় পনেরো হাজার বাসিন্দার মধ্যে শিক্ষা ও জীবিকার উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক সম্প্রীতি এই এলাকার সবচেয়ে বড় শক্তি। স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে পুজোর সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, যেখানে কবিতা, গান ও নাটকের মাধ্যমে প্রকাশ পায় ভালোবাসা ও ঐক্যের বার্তা।
 
বর্তমান সময়ে সমাজে যখন বিভাজন ও ঘৃণার আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, তখন কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্ম নয়, মানবতাই আসল পরিচয়। এই গ্রাম যেন গোটা বাংলার এক প্রতীকচিহ্ন, যেখানে মন্দিরের ঢাকের সঙ্গে মসজিদের আজান একসঙ্গে মিশে যায় উৎসবের আবহে।
 
কাগ্রামের মানুষ বিশ্বাস করেন, দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা মানেই মায়ের মমতা, ঐক্য ও ভালোবাসার উপাসনা। তাই প্রতি বছর তারা নতুন উদ্যমে এই উৎসব পালন করেন। এখানে পুজো শেষ মানেই শুধু প্রতিমা বিসর্জন নয়, বরং একে অপরের হাতে হাত রেখে আবারও প্রতিজ্ঞা করা, “আমরা এক, আমাদের ধর্ম ভালোবাসা।”
 
এইভাবেই কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজো আজও বাঙালির হৃদয়ে ছুঁয়ে যায় সম্প্রীতির সুরে, মিলনের রঙে। উৎসবের এই আবহ প্রমাণ করে, যতদিন কাগ্রামের মতো গ্রাম আছে, ততদিন বাংলার মাটিতে ধর্মের নামে বিভেদ টিকবে না; টিকবে শুধু ঐক্য, মানবতা আর ভালোবাসা।


শেহতীয়া খবৰ