শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
ধর্মের নামে বিভাজন যতই বাড়ুক, বাংলার মাটিতে এখনো এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির আলো কখনও নিভে যায় না। ঠিক তেমনই এক অনন্য উদাহরণ হলো নদীয়া জেলার শান্তিপুরের সূত্রাগড়ের পীরের হাট অঞ্চলের প্রাচীন জগদ্ধাত্রী পুজো। প্রায় তিনশো বছরের ঐতিহ্য বহন করে আসা এই বারোয়ারি পুজো আজও দুই সম্প্রদায়ের মিলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
একপাশে পীরের মাজার, তার পাশেই দেবী জগদ্ধাত্রীর মণ্ডপ, এই দৃশ্যই বলে দেয়, সম্প্রীতির এই পুজো শুধু ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও প্রতিচ্ছবি। এলাকার প্রবীণদের কথায়, পীরের মাজার ও জগদ্ধাত্রী পুজোর উৎপত্তি প্রায় একই সময়ের। বলা হয়, মাজারের পাশে হাট বসত বলেই এই অঞ্চলের নাম হয় ‘পীরের হাট’। এখানকার হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ বহুদিন ধরে একসঙ্গে উৎসবে মেতে ওঠেন।
স্থানীয় কাহিনি অনুযায়ী, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় স্বপ্নাদেশে দেবী জগদ্ধাত্রীকে প্রথম পূজা করেন তাঁর নিজ বাড়িতে। পরবর্তীকালে দেবীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে দিতে তিনি তাঁর হাতিশালায় এই পুজোর আয়োজন করেন, যে স্থানই আজকের পীরের হাট অঞ্চল। কথিত আছে, সেই হাতিশালার এক হাতির কবর আজও এই এলাকায় বিদ্যমান। মহারাজের নামেই আজও এই পুজোর সংকল্প করা হয় এবং প্রাচীন নিয়ম মেনে একদিনে তিনটি পূজা; সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী সমাধা করা হয়।
বর্তমানে এই পূজা পরিচালনা করেন শান্তিপুরের খ্যাতনামা পুরোহিত শ্রী সব্যসাচী পাঠক, যিনি বংশপরম্পরায় এই পূজার দায়িত্ব পালন করছেন। দেবীর রূপ এখানে পীতবর্ণা, ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, সিংহবাহিনী, পদতলে করিন্দ্রাষুরের ছিন্ন মস্তক, এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিমা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই রূপে নির্মিত হয়ে আসছে।
এই বারোয়ারীর অন্যতম আকর্ষণ দেবীর পিছনের চালচিত্র, যা স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম যুবকেরা কয়েক সপ্তাহ ধরে নিজেরা হাতে হাতে বানিয়ে তৈরি করেন। পুজোর সময় পুরো পীরের হাট অঞ্চল আলোর ঝলকে, ঢাকের বাদ্যে মুখরিত হয়ে ওঠে। মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত এই পূজায় বিশেষ রীতি হিসেবে দেবীর সামনে ইক্ষু, কদলী ও কুস্মাণ্ড বলি দেওয়া হয়। পূজার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রায় পনেরো থেকে ষোলো ঘণ্টা ধরে নিরবচ্ছিন্ন হোম সম্পাদন, যা পীরের হাটের জগদ্ধাত্রী পুজোকে অনন্য করে তোলে।
ভোগের সময়ও থাকে এক বিশেষ আচার। তিনটি পূজায় তিনবার ভোগ নিবেদন করা হয়, খিচুড়ি, চচ্চড়ি, পুষ্পান্ন, পরমান্ন, চাটনি, ভাজা, মিষ্টি সহ নানাবিধ পদে দেবীকে নিবেদন করা হয়। পাশাপাশি চণ্ডীপাঠ ও ধূনোপোড়ানো অনুষ্ঠান হয়, যেখানে বহু দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা মনস্কামনা পূরণের আশায় অংশ নেন।
শান্তিপুরের স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, সিদ্ধেশ্বরী মা অর্থাৎ এই “বড়ো মা” হলেন অঞ্চলের অভিভাবক দেবী। তাই প্রতিবছর নৈবেদ্য জলে ভাসানোর আগে বাদ্য বাজনা ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বড়ো মার উদ্দেশে বিশেষ প্রণাম জানানো হয়। একইসঙ্গে সূত্রাগড়ে আরেকটি অনুরূপ প্রতিমা রয়েছে, যিনি “ছোট মা” নামে পরিচিত। প্রতিবছর নিরঞ্জনের পূর্বে ছোট মা এসে বড়ো মাকে দর্শন করেন, এই রীতি আজও পালিত হয়।
আগে নিরঞ্জনের সময় বেয়ারারা কাঁধে করে দেবীকে নিয়ে যেতেন। এখন সেই ঐতিহ্য ট্রাকটারে স্থানান্তরিত হলেও রীতির মর্যাদা অটুট। নিরঞ্জনের আগে দেবীকে মন্দির থেকে বের করে স্থানীয় এক প্রাচীন তেঁতুল গাছের তলায় বিশ্রাম দেওয়া হয়, তারপর বাদ্য বাজনা ও আলোর রোশনাইয়ের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ হয় নিরঞ্জন।
পীরের হাটের এই তিনশো বছরের জগদ্ধাত্রী পুজো আজও প্রমাণ করে, ধর্ম যতই আলাদা হোক, বিশ্বাস ও উৎসবের মেলবন্ধনই বাংলার প্রকৃত সংস্কৃতি। এখানে পীরের মাজার আর দেবীর মণ্ডপ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, শান্তিপুরের এই ভূমি আজও বলে, “একই আকাশের নীচে, একসঙ্গে উৎসব মানেই সম্প্রীতির চিরন্তন পরিচয়।”