লখনউয়ে ইতিহাসের মুখোমুখি সংলাপ: মুসলিম আলেমদের সঙ্গে RSS প্রধান মোহন ভাগবতের খোলামেলা বার্তা

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 d ago
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার মুহূর্তে মোহন ভাগবত
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার মুহূর্তে মোহন ভাগবত
 
আওয়াজ দ্যা ভয়েস, নয়াদিল্লি

“আগে জমি প্রস্তুত করতে হয়, তারপর সেখানে হাঁটা যায়। সংঘের শত বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এমন কিছু হচ্ছে। এখন এটিকে প্রান্ত স্তর পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। আজ আমি আপনাদের মধ্যে এসেছি, সামনে সংঘের অন্যান্য শীর্ষ নেতারাও আপনাদের সঙ্গে সংলাপে বসবেন।”, এই কথাগুলি বলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS)-এর সরসংঘচালক ড. মোহন ভাগবত। ২৩ নভেম্বর লখনউয়ে মুসলমানদের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য রাখেন।
 
এই অনুষ্ঠানটি ইন্টারফেইথ হারমনি ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার ব্যানারে আয়োজিত হয়, যার সভাপতিত্ব করেন ড. খ্বাজা ইফতিখার আহমেদ। প্রায় এক মাস কুড়ি দিন আগে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের ভিডিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ‘মিটিং অফ মাইন্ডস’-এর প্রকাশিত এই ভিডিওতে শিয়া ধর্মগুরুদের সহ প্রায় ১০০ জন ইসলামি পণ্ডিতের উপস্থিতি দেখা যায়।
 

ভিডিওর বিবরণে দাবি করা হয়েছে, লখনউয়ে এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে RSS প্রধান মোহন ভাগবত ইসলামের পাঁচটি প্রধান মতবাদ, হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি, হাম্বলি ও জাফরি, এর প্রতিনিধিত্বকারী শতাধিক প্রবীণ মুসলিম বিদ্বানকে উদ্দেশ করে ভাষণ দেন। ২৩ নভেম্বর ২০২৫-এ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানকে ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো RSS ও মুসলিম বিদ্বানদের মধ্যে প্রকাশ্য, মুখোমুখি সংলাপ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
 
অনুষ্ঠানে ১০০-রও বেশি উলেমা, বুদ্ধিজীবী ও সমাজনেতা পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার পরিবেশে একত্রিত হন। মূল বক্তব্য দেন সরসংঘচালক ড. মোহন ভাগবত। ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. খ্বাজা ইফতিখার আহমেদ তাঁর সূচনাপর্বের বক্তব্যে সংলাপের আবহ তৈরি করেন। লখনউয়ের সমন্বয়কারী অধ্যাপক শাকিল কিদওয়াই শহরের পক্ষ থেকে অতিথিদের স্বাগত জানান।
 
ড. ভাগবত তাঁর বক্তব্যে বলেন, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে হাজার বছরের পুরনো ভুল বোঝাবুঝি এক ঝটকায় দূর করা সম্ভব নয়। এর জন্য ধৈর্য ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন; তাড়াহুড়ো করলে কাজ উল্টোও হতে পারে। তিনি বলেন, সংঘের শতবর্ষ উপলক্ষে তিনি বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং সেই ধারাবাহিকতায় আজ মুসলমানদের মাঝেও এসেছেন।
 
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই অনুষ্ঠানে আসার আগে কিছু মানুষ দিল্লির বোমা বিস্ফোরণের প্রসঙ্গ তুলে তাঁকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করেন। “এখানে বসে থাকা মানুষরা তো সন্ত্রাসবাদী নন, যাদের সঙ্গে দেখা করতে আমি এসেছি”, স্পষ্ট ভাষায় বলেন তিনি।
 
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার মুহূর্তে মোহন ভাগবত
 
ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে ড. ভাগবত বলেন, ভারতে সময়ে সময়ে বহু আক্রমণ হয়েছে, নানা ধর্মের মানুষ এখানে এসেছে, যার ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশরা শুধু এই ভুল বোঝাবুঝির অপব্যবহারই করেনি, বরং তা আরও বাড়িয়েছে। “এগুলো দূর করা আমাদের সকলের যৌথ দায়িত্ব। সংঘের দর্শন এটাই, ভারত তখনই বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে, যখন আমরা এক হব,” তিনি বলেন। তিনি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের ভাবনার উল্লেখ করে বলেন, আজকের সংঘ সেই দর্শনকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
 
তাঁর মতে, ভারতে বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষ, যে নিজেকে হিন্দু, বা ভারতীয় মনে করে, আসলে এক, কেবল প্রকাশের ধরন আলাদা। তিনি বলেন, আগে সংঘ হিন্দু ও সনাতন পরম্পরার অনুসারীদের সংগঠিত করেছে, ফলে সমাজ শক্তিশালী হয়েছে এবং আজ তাদের কথা শোনা হয়। “এখন আমরা অন্য সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও যাচ্ছি। উপাসনার পদ্ধতি আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমরা ১৪৪ কোটি মানুষই ভারতীয়”,  জোর দিয়ে বলেন তিনি।
 
মব লিঞ্চিং প্রসঙ্গে ড. ভাগবত স্পষ্ট করেন যে এটি সংঘের দৃষ্টিভঙ্গি নয়। যদি সংঘের সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তি এমন কাজে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়, সংগঠন তার সমর্থন করে না। “এমন ক্ষেত্রে আমরা মানুষকে আইনের আশ্রয় নিতে বলি। সংঘের দৃষ্টিভঙ্গি লড়ানোর নয়, জোড়ার”, বলেন তিনি।
 
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংঘের সঙ্গে সরকারের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই, যদিও সংঘের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ সরকারের মধ্যে রয়েছেন, যাদের মাধ্যমে সংঘের কথা সেখানে পৌঁছায়। তবে রাজনীতি ভোটের উপর চলে, তাই সরকার সিদ্ধান্তও সেই হিসেব দেখেই নেয়। মুসলমানদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, বহুবার সম্প্রদায়ের কথা সরকারের কাছে পৌঁছেছে, কিছু মানা হয়েছে, কিছু হয়নি।
 
সংঘে মুসলমানদের যুক্ত করার প্রশ্নে তিনি বলেন, ঐক্যের মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব, কিন্তু এই প্রক্রিয়াও ধীরে ধীরেই এগোবে। তিনি আবারও বলেন, “তাড়াহুড়ো করলে কাজ বিগড়ে যায়।”
 
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ইসলামিক পণ্ডিতরা
 
তবে এই ভাইরাল ভিডিওকে ঘিরে সমালোচনাও তীব্র হয়েছে। কমেন্ট বক্সে যেখানে অনেকে ড. ভাগবতের বক্তব্যকে সমর্থন করছেন, সেখানে বিরোধিতাও কম নয়। কিছু মন্তব্যে ড. খ্বাজা ইফতিখার আহমেদ ও জাফর সেরেশওয়ালার নাম উল্লেখ করে অনুষ্ঠানটিকে ‘প্রযোজিত’ বলে দাবি করা হয়েছে। এক ব্যবহারকারী লেখেন, “আগে জাফর সেরেশওয়ালা, এখন খ্বাজা ইফতিখার আহমেদ, দু’জনেই প্রযোজিত অনুষ্ঠানের আয়োজক। হাতির দাঁত এক রকম দেখানোর, আরেক রকম খাওয়ার।”
 
আরেকটি মন্তব্যে অভিযোগ করা হয়েছে, RSS তাদের গোপন এজেন্ডার প্রচার চালাচ্ছে এবং সচেতন মানুষরা এর লুকানো উদ্দেশ্য বুঝতে পারছেন। মন্তব্যকারীর মতে, “আমাদের স্লোগান ছিল ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’, কিন্তু এখন তা ‘বৈচিত্র্য থেকে ঐক্য’-তে বদলে দেওয়া হচ্ছে। এতে মুসলমান, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র পরিচয় অস্বীকার করা হচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এটাই আসল এজেন্ডা।”
 
এইভাবে, লখনউয়ের এই অনুষ্ঠান একদিকে যেমন সংলাপ ও সম্প্রীতির নতুন উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে এটি গভীর রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতেও পরিণত হয়েছে।