আমেরিকার বিলাসবহুল জীবন-যাপন ছেড়ে প্রাকৃতিক চাষ ও মহিলাদের চাষে আগ্রহী করতে উদ্যোগী দম্পতি

Story by  Shanti Roy Chowdhury | Posted by  Aparna Das • 4 d ago
দেবল মজুমদার ও অপরাজিতা সেনগুপ্ত ,আর রূপপুর গ্রামে অবস্থিত তাদের বাড়ি
দেবল মজুমদার ও অপরাজিতা সেনগুপ্ত ,আর রূপপুর গ্রামে অবস্থিত তাদের বাড়ি
 
শান্তিপ্রিয় রায়চৌধুরী

দেবল মজুমদার ও অপরাজিতা সেনগুপ্ত। এরা একজন বর্ধমান জেলার বাসিন্দা আর অন্যজন কলকাতার বাসিন্দা। এরা আমেরিকার বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি, বিলাসবহুল জীবন-যাপন ছেড়ে মাটির টানে ২০১১ সালে নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসে প্রাকৃতিক চাষে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। নিজেরা চাষ আবাদ করার পাশাপাশি এলাকার বহু মানুষকে  প্রাকৃতিক চাষ নিয়ে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন তাঁরা। তাদের গবেষণার বিষয় প্রাকৃতিক চাষে ফলন কতটা নির্ভেজাল হয়। এর পাশাপাশি ভারতের মতো কৃষিপ্রধান দেশে কেন মহিলা চাষির সংখ্যা কম তা নিয়েও এলাকার মানুষকে বোঝাচ্ছেন। 

বর্ধমানের বাসিন্দা দেবল মজুমদার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফটওয়্যার  ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। চাকরি পান আমেরিকার কেন্টাকির একটি বহুজাতিক একটি সংস্থায়। আর কলকাতার বাসিন্দা অপরাজিতা সেনগুপ্ত  প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পিএইচডি করতে ৷ ডিগ্রি পাওয়ার পর সেখানেই পড়ানো শুরু করেছিলেন।
 
রুপপুর গ্রামে অবস্থিত দেবল মজুমদার ও অপরাজিতা সেনগুপ্তের বাড়ি একটি ছবি
 
আমেরিকাতে থাকাকালীন এই দুই দম্পতিকে ভাবিয়ে তোলে বর্তমানে কেন খাদ্যদ্রব্যে স্বাদ কম, আর সেই সঙ্গে খাদ্যে ভেজালের পরিমাণ বাড়ার মতো বিষয়টাও তাদের ভাবিয়ে তুলেছিল। আমেরিকার একাধিক গ্রাম ঘুরে তা নিয়ে আরও জানতে শুরু করেন৷ এরপরেই হঠাৎ আমেরিকার  বিলাসবহুল জীবন-যাপন ছেড়ে মাটির টানে দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা করেন। করেন ফার্মাকালচার কোর্স। চাকরি জীবনের জমানো টাকা থেকে শান্তিনিকেতনের অদূরে রূপপুর গ্রামে পুকুর-সহ সাড়ে ৫ বিঘা জমি কিনে শুরু করেন চাষ নিয়ে গবেষণা৷
 
রাসায়নিক সার ব্যবহারে ফসলের স্বাদ, গুণাবলী নষ্ট হয়। উপরন্তু, কীটনাশক ব্যবহারে ক্ষতি হয় মানবদেহের ৷ এছাড়া, ভারতবর্ষের মতো কৃষিপ্রধান দেশে মহিলা চাষির সংখ্যা কম৷ চাষের কাজে অংশ নিলেও মহিলাদের নামে জমি না-থাকায় তাদের চাষি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এই নিয়েই গবেষণা এই দম্পতির।
 
অপরাজিতা সেনগুপ্ত তাদের সব্জির বাগানে
 
বর্তমানে অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দেন তাঁরা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত-সহ বাংলাদেশ, আমেরিকা, ফ্রান্স, সুইডেন প্রভৃতি দেশ থেকে আগ্রহী পড়ুয়া তাঁদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে থেকে প্রাকৃতিক চাষ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও হাতে-কলমে গবেষণায় অংশ নিয়ে গিয়েছেন। এমনকী ফার্মাকালচার নিয়ে পড়ানোর জন্য সাম্মানিক অধ্যাপক হিসাবে ভারতের বিভিন্ন কৃষি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নেপাল, বাংলাদেশ, আমেরিকা থেকে ডাক পেয়েছেন এই দম্পতি।
 
দেবল মজুমদার ও অপরাজিতা সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘‘ক্রমশ বিশ্ব এক উলটো পথে হাঁটছে। খাবারে বিষ দিচ্ছি, হাওয়া দূষিত হয়ে উঠছে, মহিলারা চাষের কাজ করলেও ভারতে তাদের নামে জমি কম। তাই মহিলারা চাষি হিসাবে স্বীকৃতি পান না। এসব নিয়ে আমরা না-ভেবে বাড়ি-গাড়ি কেনাকাটায় মন দিই বেশি। আমরা আমেরিকায় স্থানীয় খাবারের বিষয়ে ভাবা শুরু করি। তারপরেই এই সিদ্ধান্ত নিই। সব কিছু ছেড়ে এখানে চলে আসা। নিজেরা প্রতি মুহুর্তে ভুল করতে করতে শিখি, অপরকেও শেখাই৷ এভাবেই সাবলীলভাবে আমাদের দিন কেটে যাচ্ছে।’’
 
ডাবল মজুমদার ও অপরাজিতা সেনগুপ্ত তাদের  বাগানে
 
বর্তমানে শান্তিনিকেতন মাটি ও কাঠ দিয়ে তৈরি একটি বাড়িতে তাঁরা বসবাস করে থাকেন। খামারে ৭ রকমের দেশি ধান, ডাল, গম, বিভিন্ন রকমের লেবু, আম, আতা, পেয়ারা, করমচা, সবেদা, কামরাঙা প্রভৃতি চাষ হয়। পাশাপাশি, মাছ ও হাঁসের ডিম উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত ফসল নিজেরা খান, উদ্বৃত্ত ফসল ও জ্যাম-জেলি প্রভৃতি তৈরি করে বিক্রি করেন।
 
বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে মানবকল্যাণে  তাদের এই গবেষণা, সেমিনার৷ এক কন্যা সন্তান-সহ এই নিয়েই এখন দিনযাপন দেবল-অপরাজিতার। আমেরিকার বিলাসবহুল জীবন-যাপন ছেড়ে মাটির বাড়িতে থেকে স্বচ্ছল জীবন কাটানো যে যায়, তারই উদাহরণ বহন করেন একদা প্রবাসী এই দম্পতি।