দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও কীভাবে কুরআন মুখস্থ করল ইনামুল আলী

Story by  Ariful Islam | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 8 d ago
হাফিজ ইনামুল আলী
হাফিজ ইনামুল আলী

 আরিফুল ইসলাম / গুয়াহাটি

চোখে দেখতে না পেলেও ব্যতিক্রমী এক তরুণ। যার জন্য এই পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন। কিন্তু পবিত্র কুরআনের আলোই আলোকিত করে রেখেছে তার অন্তরকে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও হাফিজ হওয়ার মতো অসাধ্য সাধন করেছে সে। বন্ধু এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে কুরআনের আয়াত শুনে শুনে মুখস্থ করেছে পুরো কুরআন শরীফ। এই তরুণ হচ্ছে কামরূপ জেলার বালিকুচির তুলামাটি গ্রামের কাউছার আলী ও আফরুজা বেগমের সন্তান হাফিজ ইনামুল আলী।

চোখে না দেখতে পেলেও হাফিজ ইনামুল আলী পবিত্র কুরআন হাফিজ (মুখস্থ) করে পুরো অঞ্চলের গর্ব হয়ে উঠেছেন। ইনামুল আলী জন্মগতভাবে অন্ধ ছিল না। দেড় বছর বয়সে এক রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে।


‘আওয়াজ-দ্য ভয়েস’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হাফেজ ইনামুল আলী বলেন,“প্রথমেই আমি আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করছি। পবিত্র কুরআন হলো আল্লাহর বাণী যা আমাদের নবী হযরত মহমদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হয়েছিল। যখন প্রথমবার মাদ্রাসায় যাই, আমার উস্তাদরা বলেছিলেন ‘তুমি পারবে,এই দুনিয়ায় অসম্ভব কিছুই নেই।’ আমি আমার শিক্ষকদের পরামর্শ মেনে চলেছি,তা না হলে তাদের প্রতি অন্যায় হতো। তারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আমি হাফিজ হতে যেমন কষ্ট করেছি,তারাও আমার সঙ্গে তেমন কষ্ট ভাগ করে নিয়েছেন।”
 

হাফিজ ইনামুল আলীকে সংবর্ধনা
 
যেহেতু ইনামুল আলী চোখে দেখতে পায় না,তাই কুরআন পড়া ও মুখস্থ করার ক্ষেত্রে তাকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। নিজের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং অদম্য অধ্যবসায়ই ইনামুল আলীকে একজন সফল হাফিজে পরিণত করেছে।
ইনামুল আলী তার শিক্ষকদের বা সহপাঠীদের কাছ থেকে কুরআনের প্রতিটি আয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনত এবং সেই আয়াতগুলো বারবার উচ্চারণ করে মুখস্থ করত।

তিনি বলেন,“আস্তে আস্তে মুখস্থ করে আমি শিক্ষকদের শুনাতাম। এভাবেই মানুষের দোয়া এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সহায়তায় মহান আল্লাহ আমাকে হাফিজ-কুরআন বানিয়েছেন। শুরুতে আমি দিনে ৪-৫টি আয়াত করে শুনাতাম। কিছুদিন পর ৭-৮টি আয়াত করে মুখস্থ করে শুনাতে লাগলাম। সবচেয়ে বেশি একবারে আমি ৭৫টি আয়াত মুখস্থ করে আমার শিক্ষককে শুনিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরাও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। ওরা নিজের পড়ার সময় নষ্ট করে হলেও আমাকে কুরআন মুখস্থ করাতে সাহায্য করেছিল।”

মাদ্রাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য কাজেও ইনামুলকে সহপাঠীরা যথেষ্ট সাহায্য করেছে।ইনামুল আলীর সহপাঠী বন্ধুরা মাদ্রাসায় পড়াশোনার সময় কেবল পড়ালেখায়ই নয়,বরং অন্যান্য দৈনন্দিন কাজেও তাকে অনেক সাহায্য করত। তার শিক্ষকরা সবসময় তার পাশে একজন সহপাঠী রাখতেন যেন প্রতিটি কাজে তাকে সঠিকভাবে গাইড করা যায়। যদিও ইনামুল একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী,তবুও নতুন কোনো জায়গায় দুদিন চলাফেরার পরই সে নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারত।
"এখন আমার ছেলেটির যেহেতু এখন উপযুক্ত বয়স হয়েছে,তাই তাকে যদি আমরা বিয়ে দিতে পারি,তাহলে আর চিন্তা থাকবে না। যখন সে ছোট ছিল এবং কিছু খাওয়ার জন্য খুঁজে বেড়াতো,একজন মা হিসেবে আমার কেমন লাগতো তা আপনি কল্পনা করতে পারেন? আমি মাঝেমধ্যে ভেঙে পড়তাম। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা সবকিছু নিজে আয়ত্ত করতে শিখে গেল। একজন মা হিসেবে যদিও আমার কষ্ট লাগে,কিন্তু এখন সে নিজের সব কাজ নিজে করতে পারে,আর আমাদের দেখিয়ে দিতে হয় না। আমরা বাড়িতে না থাকলেও সে নিজেই সব কিছু সামলে নিতে পারে। এসব কথা ভাবলে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি,"বললেন মা আফরুজা বেগম।
 

হাফিজ ইনামুল আলীর মা আফরুজা বেগম
 
উল্লেখযোগ্য যে, মা-বাবার পাশাপাশি ইনামুল আলী নিজেও ছোটবেলা থেকে একজন হাফিজ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। ইনামুল আলী প্রতি বছর রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়ানোর পাশাপাশি দ্বীনি তাবলিগের সঙ্গেও যুক্ত। ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে 'আওয়াজ-দ্য ভয়েস'এর সামনে তিনি ভবিষ্যতে একজন ভালো 'কারি'(কোরআন তেলাওয়াতকারী) হতে চান বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

হাফিজ ইনামুল আলী একাধিক মাদ্রাসায় হাফিজ (কুরআন মুখস্থ)শিক্ষা গ্রহণ করেছে। শুরুতে সে তার বাড়ির কাছে বাইরাহা শৌলমারী হাফিজ মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করে। সেখানে তার প্রথম শিক্ষক ছিলেন হাফিজ কারি আফতাবুদ্দিন আহমেদ। ইনামুল বলেন,“তিনি-ই আমাকে প্রথম কুরআনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর আমি পড়ি দরং জেলার কতাহী গঙ্গাপুখুরী হাফিজ মাদ্রাসায়। তারপর মারৈ হাফিজ মাদরাসায় পড়ি। পরে আমার এক বন্ধু আমাকে রঙিয়ার দারুল উলুম আশরাফিয়া মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়। সেখানে আমি আমার শিক্ষক ও বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছিলাম। আমি সেখানে হাফিজ খাইরুল ইসলাম সাহেবের কাছে কুরআন মুখস্থ শুনিয়েছিলাম। তিনি শুধু আমার শিক্ষকই ছিলেন না,বরং একজন অভিভাবকের মতো আমাকে সহায়তা করেছিলেন। সেখানে হাফিজ ছামনুর সাহেব এবং প্রধান শিক্ষক নজরুল হুজুরও আমাকে অনেক স্নেহ করতেন।”

ইনামুলের মা আফরুজা বেগম বলেন,“একবছর পাঁচ মাস বছর বয়সে আমার ছেলেটি এক রোগে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। প্রথমে আমরা তাকে স্কুলে ভর্তি করি,কিন্তু আমার মনে সবসময় একটা কথা ঘুরত তাকে হাফিজ বানাতে হবে। আজ আমি আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমার ছেলেকে হাফিজ বানিয়েছেন। আমাদের গ্রামের মানুষ,শিক্ষক,এবং সহপাঠীরা সবাই তাকে অনেক সাহায্য করেছেন। যেহেতু আমাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না,তাই আর্থিকভাবেও মানুষ সাহায্য করেছে। আমরা তাকে ১২ বছর বয়সে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিই। প্রথমে আমার মন খারাপ হতো,কিন্তু আজ আমি চিরকৃতজ্ঞ। আল্লাহর কাছে যা চেয়েছিলাম,সেটা তিনি দিয়েছেন।”

তিনি আরও বলেন,এখন যেহেতু আমার ছেলের উপযুক্ত বয়স হয়েছে,তাই যদি তাকে বিয়ে দিতে পারি,তাহলে আর কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। যখন সে ছোট ছিল,কিছু খেতে চাইলে আমাকে খুঁজে বেড়াত,তখন একজন মা হিসেবে আমার কেমন লাগতো! মাঝে মাঝে আমি ভেঙে পড়তাম। কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সব কিছু আয়ত্ত করতে শিখে গেল। একজন মা হিসেবে যদিও কষ্ট লাগে,এখন সে সব কাজ নিজেই করতে পারে। এখন আর আমাদের দেখিয়ে দিতে হয় না। আমরা বাড়িতে না থাকলেও সে নিজেই নিজের সব কাজ করে নিতে পারে। এটা ভাবলেই আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।”