ভারতীয় রেলের মেরুদণ্ড: কোটি কোটি যাত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে "রেলওয়ের গ্যাংম্যান”

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 h ago
ভারতীয় রেলওয়ের গ্যাংম্যান
ভারতীয় রেলওয়ের গ্যাংম্যান
 
অরুণ কুমার দাস / গুয়াহাটি

ভোরের কোমল আলোয় যখন দিল্লির সদর বাজার রেললাইনের চারপাশ জেগে ওঠে, তখনই অঙ্কেশ রেলওয়ের ইউনিফর্ম পরে, হাতে হাতুড়ি নিয়ে কাজে নামার জন্য প্রস্তুত। মুহূর্ত পরে একটি বিশাল মালগাড়ি বজ্রনাদ তুলতে তুলতে পাশ দিয়ে চলে যায়। লাইন কেঁপে ওঠে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে লোহার শব্দ। ট্রেনটি চোখের আড়ালে মিলিয়ে যেতেই অঙ্কেশ নেমে পড়ে তার আসল দায়িত্বে, রেলপথের খুঁটিনাটি পরীক্ষা ও মেরামতের কাজে।

সে রেললাইন ভালভাবে পরীক্ষা করে মেরামতের কাজ শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সহকর্মী নীরজ এসে যোগ দেয়। দু’জনে একসাথে লোহার ট্র্যাকে হাতুড়ির আঘাতে ভোরের নীরবতা ভেঙে দেয়। ৩০ বছরের অঙ্কেশ ও নীরজ দু’জনেই ভারতীয় রেলওয়ের ট্র্যাক মেইন্টেনার। কাজটা বাইরে থেকে সহজ মনে হলেও এতে রয়েছে অপরিসীম দায়িত্ব। প্রতিদিন তারা নিশ্চিত করে যে রেললাইন মজবুত ও নিরাপদ থাকে, যাতে লক্ষ লক্ষ যাত্রীবাহী ট্রেন ও কোটি কোটি টাকার মালামাল বহনকারী মালগাড়ি বিনা বিপদে ও দেরি ছাড়া চলাচল করতে পারে।
 
ভারতীয় রেলওয়ের গ্যাং-ম্যানদের ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের একটি দৃশ্য
 
রেল মন্ত্রকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, “ট্র্যাক পরিদর্শনের জন্য মেশিন থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। আমরা এখনও রেলের নিরাপত্তা ও মসৃণ চলাচলের জন্য গ্যাংম্যানদের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।” লোকেশ প্রায় ১০ কেজি ওজনের একটি টুলকিট নিয়ে ঘোরে। এর মধ্যে থাকে হাতুড়ি, রেঞ্চ, ফ্ল্যাগ, ডায়েরি, স্প্যানার, পানির বোতল ইত্যাদি। এমনকি তারা ডিটোনেটরও বহন করে, যা ঘন কুয়াশার সময় চালককে সতর্ক করতে ব্যবহার করা হয়।
 
এসময় পাশ দিয়ে স্টেশনে ঢুকে পড়ে পাশ্চিম এক্সপ্রেস, তারপর দ্রুতগতিতে চলে যায় তেজস ভুবনেশ্বর রাজধানী ও গোমতী এক্সপ্রেস। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সঙ্গে যোগ দেন সিনিয়র জামাদার মুকেশ, যার দায়িত্ব ২০ জন গ্যাংম্যানের তত্ত্বাবধান করা, মাস্টার রোল রাখা এবং ডিউটি চার্ট তৈরি করা। রেললাইনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ডিউটি চার্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
 
স্টেশনের বাইরে আরও দুই গ্যাংম্যান, সিধাকান্ত ও মুকেশ, দলে যোগ দেয়। দুপুর গড়িয়ে আসতেই সূর্য মাথার উপর তীব্রভাবে জ্বলে ওঠে, আর সময় হয় মধ্যাহ্নভোজনের। সদ্য পেরিয়ে যাওয়া ১৭ই সেপ্টেম্বরের বিশ্বকর্মা পুজোর উপলক্ষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজানো একটি শেডে তারা একত্র হয়। স্নাতক ডিগ্রিধারী গ্যাংম্যান মুকেশ জানান, “আমরা এখানে প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পূজা পালন করি।”
 
প্রকৃতপক্ষে বহু স্নাতক, এমনকি স্নাতকোত্তরও এই ধরনের লেভেল-১ চাকরিতে যোগ দেন। ইতিহাস ও হিন্দি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী কৈলাশ, যিনি বিএড-ও করেছেন, বলেন, “ট্র্যাক মেইনটেনেন্স করতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রত্যেক কাজের নিজস্ব মর্যাদা আছে। আসল সমস্যা হলো পদোন্নতির অভাব। অন্তত আমাদের উচ্চপদে উন্নীত হওয়ার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত।” আশেপাশের আরও গ্যাংম্যানরা আসতেই তাদের মধ্যাহ্নভোজন এক ধরনের সম্মিলিত সমাবেশে রূপ নেয়, দিনের কাজের প্রয়োজনে কখনও দুই ঘণ্টা, কখনও তিন ঘণ্টা ধরে চলে।
 
গ্যাং-ম্যানদের দুপুরের খাবারের সময়
 
কীম্যান রোশনলাল বলেন, “যদি অন্য কোনো সেকশনে জরুরি পরিস্থিতি না থাকে, আমরা সাধারণত বিশ্রাম নেওয়ার ও একসাথে খাওয়ার সুযোগ পাই।” ট্র্যাক মেইনটেনার জিতেন্দ্র যোগ করে, “আজ একটা ভাল দিন; আমরা সবাই একসাথে খাচ্ছি। কিন্তু কিছু দিন এমনও হয়, যখন উপযুক্ত বিরতিও পাই না।”
 
দুপুর তিনটার মধ্যে বৃষ্টি থেমে যায়। অঙ্কেশ ও নীরজ আবার হাতুড়ি তুলে কাজে নামেন। সন্ধ্যা ছ’টার আগে সদর বাজার স্টেশনে ফিরতে হলে তাদের আরও তিন কিলোমিটার ট্র্যাক অতিক্রম করতে হবে। নীরজ হাসতে হাসতে বলে, “আমরা বাইরে বেরোলে সকালের হাঁটাহাঁটি করা মানুষদের দেখি, আর ফেরার পথে দেখি সন্ধ্যার হাঁটাহাঁটি করা মানুষদের।”
 
ফেরার পথে এক কীম্যানের কাছ থেকে তাদের বার্তা আসে, দ্রুত স্টেশনের কাছের এক স্থানে যেতে হবে। অঙ্কেশ বলেন, “একটা ছোটখাটো ত্রুটি ধরা পড়েছিল, যেটা আমরা সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করলাম। এগুলো নিয়মিত ব্যাপার, আমরা সবসময় জরুরি অবস্থায় সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।”
 
উল্লেখ্য, ভারতীয় রেলওয়েতে ট্র্যাক মেইনটেনেন্স তিনটি শিফটে করা হয়। কারণ রেললাইন নিরাপদ রাখা মসৃণ চলাচলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষা, প্রচণ্ড গরম কিংবা হিমশীতল শীত, যেকোনো পরিস্থিতিতেই গ্যাংম্যানরা দায়িত্ব পালন করে, ট্র্যাক পরীক্ষা করে ও মেরামত করে।
 
গ্রীষ্মকালে রেললাইন প্রসারিত হয় এবং শীতকালে তা সংকুচিত হয়, দুটো অবস্থাতেই ফাটল ধরতে পারে, যা দ্রুত মেরামত করা জরুরি। ভাপ ইঞ্জিনের যুগ থেকে ডিজেল ইঞ্জিন, এবং এখন বিদ্যুৎচালিত ও আসন্ন হাইড্রোজেনচালিত রেলের যুগে প্রযুক্তির বহু পরিবর্তন এলেও ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণ এখনও মূলত মানুষের শ্রমের উপর নির্ভরশীল।
 
প্রতীকী ছবি
 
যদিও এখন মেশিন ত্রুটি শনাক্ত করতে পারে, তবুও গ্যাংম্যানরাই রেলওয়ের নিরাপত্তার মেরুদণ্ড। ভারতীয় রেলওয়ের ১৭ স্তরের চাকরির শ্রেণিবিন্যাসে সবচেয়ে ওপরে লেভেল-১৭ তে রয়েছেন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান, আর একেবারে নিচে লেভেল-১ এ রয়েছেন ট্র্যাক মেইনটেনার বা গ্যাংম্যান।
 
বর্তমানে ভারতীয় রেলওয়েতে প্রায় ৪ লাখ গ্যাংম্যান কর্মরত, যা যেকোনো শ্রেণির মধ্যে সর্বাধিক কর্মশক্তি। তাদের মাসিক বেতন গড়ে ৩৫,০০০ থেকে ৪৮,০০০ টাকা। সঙ্গে বার্ষিক বোনাস ১৭,৯৫১ টাকা, বাড়ি, স্বাস্থ্যসুবিধা, এবং স্লিপার ও এসি দুই ধরনের ট্রেনে বিনামূল্যে ভ্রমণের সুবিধাও রয়েছে।
 
দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকায় তারা ৩,৫৭৫ টাকার ঝুঁকি ভাতাও পায়। বর্তমানে সংক্রমণ ভাতারও দাবি বাড়ছে, কারণ রেললাইনের পাশে জমে থাকা আবর্জনার ফলে প্রায়শই তারা স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ন্যূনতম যোগ্যতা দশম শ্রেণি পাশ বা আইটিআই হলেও, স্নাতক, স্নাতকোত্তর, বিএড কিংবা বিটেক ডিগ্রিধারীরাও এই চাকরির জন্য আবেদন করেন এবং নিযুক্ত হন।
 
রেল দ্রুতগতিতে ছুটে চললেও অধিকাংশ যাত্রী তা খেয়াল করেন না, কিন্তু অঙ্কেশ, নীরজ, লোকেশ, মুকেশ ও তাদের সহকর্মী গ্যাংম্যানরা নীরবে নিশ্চিত করেন যে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ যাত্রী নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন। তাদের নিষ্ঠা ও সাহস আরও বেশি স্বীকৃতির যোগ্য।