শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ/কলকাতা
নবরাত্রির অষ্টমী তিথি মানেই দুর্গোৎসবের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন প্রতি বছরের মতোই বেলুড় মঠে পালিত হয় কুমারী পুজো। উল্লেখ্য , বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল বিগত ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে। প্রথাগতভাবে দুর্গাপুজো, সঙ্কল্প কিংবা কুমারী পুজো ছিল গৃহস্থের আচার, কিন্তু স্বামীজি সেই বাঁধাধরা প্রথা ভেঙে ঘোষণা করেছিলেন— “মানুষের সেবাই ঈশ্বরসেবা”। এই মানবসেবার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোর প্রবর্তন হয়।
প্রথমবার রামকৃষ্ণ মঠে দুর্গাপুজো হয়েছিল শ্রীশ্রীসারদা মা-এর উপস্থিতিতে। সঙ্কল্পও হয়েছিল তাঁর নামেই। তখন থেকেই কুমারী পুজোকে দুর্গাপুজোর অন্যতম অঙ্গ হিসেবে চালু করেন স্বামীজি। অল্পবয়সী কন্যাশিশুর পায়ে পুষ্পাঞ্জলি, মিষ্টি ও দক্ষিণা নিবেদন করে মায়ের আরাধনা করা হয়। আজও সেই প্রথা অটুট আছে।
সালটা ১৮৯৮, বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ বিশ্বকে সনাতনের বেদবাণী উপহার দিয়ে ভারতে ফিরে এসেছেন এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে কাশ্মীরে গিয়ে পৌঁছেছেন। বাংলা তখন মা দুর্গার আরাধনায় মেতেছে। সেদিন অষ্টমী তিথি। বছর চারের এক মুসলিম কন্যাকে দেখে হিন্দু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ভারত মাতা রূপে তার বন্দনা করলেন, সেই পুজোতে আয়োজনের কাজ করলেন খ্রিস্টান ধর্মের নোবেল মার্গারেট (ভগিনী নিবেদিতা)। সেই থেকে আজও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে মহা অষ্টমীর তিথিতে সেই প্রথা মেনে কুমারী পুজো করা হয়ে থাকে। তিনি ব্রহ্ম তিনি বিষ্ণু তিনি দেব মহেশ্বর, তিনি সকলের আধ্যাত্মিক পিতা, সেই তিনি সঙ্ঘের অধ্যক্ষ, যিনি মহামায়ার চরণতলে আভূমি লুন্ঠিত প্রণাম করছেন । তিনি স্বামী বিবেকানন্দ।
ভোগের বৈশিষ্ট্য
বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোর আরেক বিশেষ দিক হল ভোগ। প্রতিদিন মায়ের উদ্দেশে নিবেদন করা হয় দশ থালা ভোগ— তার মধ্যে আটটি আমিষ ও দুটি নিরামিষ। মা দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, নবপত্রিকা, মহিষাসুর, মহাসিংহ, দেবী লক্ষ্মী ও দেবী সরস্বতীর জন্য আমিষ ভোগ, আর নারায়ণ ও শিবের জন্য নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়।
মহালয়া থেকেই শুরু হয় বিশেষ প্রস্তুতি— চাল বাছাই, সবজি সংগ্রহ, বিশেষ বড়ি আনা ইত্যাদি। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত সকালের বাল্যভোগে থাকে খিচুড়ি ও গোটা ইলিশ। দুপুরে ভাত, পোলাও, পাঁচরকম সিদ্ধ, নানা ভাজা, তরকারি ও পাঁঠার মাংস— যা আসে কালীঘাটের বলিপ্রথা থেকে। প্রতিদিন অন্তত পাঁচ রকম মাছের আয়োজন থাকে। রাতের ভোগে লুচি, ডাল, তরকারি, ক্ষীর, রাবড়ি ও নানা মিষ্টান্ন। দশমীতে বিশেষভাবে নিবেদন করা হয় দধিকর্মা।
মহাসন্ধিপুজোর মহিমা
মহাঅষ্টমীর মূল আকর্ষণ নিঃসন্দেহে মহাসন্ধিপুজো। এই বছর বিশুদ্ধ পঞ্জিকা অনুযায়ী সন্ধ্যা ৫টা ৪৩ মিনিট থেকে ৬টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এই বিশেষ আচার। শাস্ত্র মতে অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর প্রথম ২৪ মিনিট মিলে মোট ৪৮ মিনিট স্থায়ী হয় সন্ধিপুজো। বিশ্বাস করা হয়, এই ক্ষণেই দেবী দুর্গা চামুণ্ডারূপে অধিষ্ঠান করেন।
সন্ধিপুজোর সময় ১০৮টি পদ্ম ও ১০৮টি প্রদীপ জ্বলে ওঠে একসঙ্গে— পদ্ম প্রতীক ভক্তির, প্রদীপ প্রতীক জ্ঞানের। শঙ্খ ও ঘণ্টাধ্বনিতে মঠের প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে। ভক্তদের বিশ্বাস, এই সময় দেবী সশরীরে অধিষ্ঠান করেন ভক্তসমাজে। আগুনের দীপ্তি, শঙ্খধ্বনি ও ভক্তির উচ্ছ্বাসে যেন রূপকথার আলোয় ভেসে ওঠে গোটা মঠ।
কামারপুকুরে কুমারী পুজো
অষ্টমীর তিথিতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের রীতি মেনে বেলুড়ের পাশাপাশি কামারপুকুর মঠেও অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পুজো। এবার সেখানে কুমারী রূপে পূজিতা হল হুগলির আরামবাগের কোতলপুরের বাসিন্দা পাঁচ বছরের তানিয়া পাঠক।
মঠের মহারাজ স্বামী লোকোত্তরানন্দজি জানান, “আমাদের এবারের কুমারীর বয়স পাঁচ বছর দুই মাস। অষ্টমী পুজো উপলক্ষে প্রায় আট হাজার মানুষের ভোগের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। শাস্ত্র মতে এক বছর থেকে ষোলো বছর পর্যন্ত কুমারীকে পুজো করা যায়। তবে এখানে সাধারণত পাঁচ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সী কুমারীকেই পূজিত করা হয়। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, সব মায়ের মধ্যেই দুর্গার রূপ বিরাজমান।”
জয়রামবাটিতে কুমারী পুজো
দেখতে দেখতে এক শতাব্দী পার! ১০১ তম বর্ষে পদার্পণ করল শ্রী শ্রী মাতৃমন্দির জয়রামবাটির দুর্গাপুজো। এদিন সকালে জয়রামবাটি মাতৃ মন্দিরে অষ্টমী পুজো হয়। সকাল পাঁচটা চল্লিশ মিনিট থেকে পুজোপাঠ শুরু হয়। এরপর বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার তিথি ধরে সকাল নটায় কুমারী পুজো শুরু হয়।
এদিন সকাল ন’টায় মাতৃ মন্দিরে কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হবে বলে আগেই জানা গিয়েছিল। সন্ধি পুজোর সময় বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিট এবং মায়ের সন্ধ্যা আরতি হবে সন্ধ্যে ৬টা ৪৫ মিনিটে। প্রতি বছরের মতো এই বছরও মা সারদার পবিত্র জন্মভিটেতে কুমারী পুজো দেখতে ভিড় জমিয়েছেন এই রাজ্য সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে বিধি ও তিথি মেনে জয়রামবাটিতে মা সারদার পবিত্র জন্মস্থানে শুরু হয় কুমারী পুজো।
দীর্ঘদিনের রীতি মেনে আজ অষ্টমীতে সকাল ৯টায় তিথি মেনে কুমারী পুজো শুরু হয়। এবার কুমারী রূপে পূজিতা হল নিশিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন কুমারী পুজোর আগে মায়ের পুরনো বাড়ি থেকে কুমারীকে দুর্গা রূপে সাজিয়ে মাতৃমন্দিরে নিয়ে আসা হয়।
প্রসঙ্গত, ১৯২৫ সালে একটি পটের মাধ্যমে জয়রামবাটি মাতৃ মন্দিরে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়। ১৯৩২ সাল থেকে মাটির প্রতিমা তৈরি করে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবার ১০১ বছরে পদার্পণ করল এই পুজো। মাতৃ মন্দির চত্বরে ভক্তরা আসতে শুরু করেছেন।
মালদা রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পুজো
এদিন সকাল ৯টা ২৪ মিনিটে মহানন্দার তীরে মালদা রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরেও সম্পন্ন হয় কুমারী পুজো। এবছর সাত বছরের ঈশানী কুমারী রূপে পূজিতা হয়েছে। মালদার সানি পার্ক এলাকার বাসিন্দা ঈশানী স্থানীয় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।
মালদা মিশনের সহকারী অধ্যক্ষ স্বামী দ্বিজেন্দ্রানন্দ মহারাজ বলেন, “এক থেকে ষোলো বছরের মধ্যে যেকোনও বয়সের কন্যাশিশুই কুমারী পুজোর যোগ্য। তবে কুমারী নির্বাচনে কিছু বিশেষ লক্ষণ বিচার করা হয়। সেই অনুযায়ী এবছর ঈশানীকে নির্বাচিত করা হয়েছে।”ঈশানীর দাদু স্বপন ঝা আবেগভরে বলেন, “প্রতি বছরের মতো এ বছরও কুমারী নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল। বহু শিশুকন্যা আবেদন করেছিল। সব দিক বিবেচনা করে আমার নাতনিকে নির্বাচিত করা হয়েছে। আজ তাকে কুমারী রূপে পুজো হতে দেখে গর্বে মন ভরে গেছে।”
ঈশ্বরদর্শনের অনুভব
বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো তাই শুধু আচার-অনুষ্ঠান নয়, ভক্তদের কাছে এটি প্রত্যক্ষ ঈশ্বরদর্শনের অভিজ্ঞতা। ভোগ, প্রদীপ, পদ্ম আর ভক্তির আবহে যেন দেবী দুর্গা জীবন্ত হয়ে ওঠেন।এক ভক্ত বলেন, “মায়ের সন্ধিপুজোর সেই ৪৮ মিনিট যেন চোখের সামনে মহামায়ার আবির্ভাব। শিহরণ জাগানো মুহূর্ত।”
বেলুড় মঠে শুরু হওয়া এই প্রথা আজ ছড়িয়ে পড়েছে মিশনের বিভিন্ন শাখায়। সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে আচার, বদলেছে আয়োজন, কিন্তু অটুট থেকেছে ভক্তির আবেগ। দুর্গাপুজোর অষ্টমী তাই রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিটি মঠে আজও একইভাবে বরণ করে নেয় নারীশক্তির পূর্ণ প্রকাশকে— কুমারী রূপে দুর্গাকে।