শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
কলকাতার কুমোরটুলি যেন সারা বছরই উৎসবের আবহে মুখর। দুর্গাপুজো শেষ হতেই বিজয়া দশমীর দিনে যখন শহরজুড়ে প্রতিমা বিসর্জনের ঢাকের শব্দ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়, তখনই শুরু হয় নতুন ব্যস্ততা। মা দুর্গার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন পরবর্তী উৎসবের প্রস্তুতিতে। কারণ, কলকাতা এবং বাংলার উৎসব ক্যালেন্ডার এতই সমৃদ্ধ যে একটির সঙ্গে আরেকটি প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হাজির হয়।
প্রতিবছরের মতো এবছরও বিজয়া দশমীর পরদিন থেকেই কুমোরটুলির কারিগরদের হাতে নতুন তালিকা এসে পৌঁছেছে। কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, শ্যামাপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো থেকে শুরু করে বিভিন্ন বারোয়ারি এবং বাড়ির পুজো, সব মিলিয়ে চাহিদার শেষ নেই। বিশেষ করে কালীপুজোর প্রতিমা তৈরিতে এখন জোরকদমে কাজ চলছে। দুর্গার মতোই কালীমূর্তি, শ্যামামূর্তি বা জগদ্ধাত্রী প্রতিমার অর্ডারও সমানতালে আসে। ফলে প্রতিটি কারখানায় এখন কাঠামো বাঁধাই, মাটির প্রলেপ দেওয়া এবং রঙের কাজে ব্যস্ত শিল্পীরা।
কুমোরটুলিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত শিল্পীরা
কুমোরটুলির প্রবীণ কারিগরদের কথায়, দুর্গাপুজো তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলেও, আর্থিক দিক থেকে অন্যান্য পুজোগুলির গুরুত্বও কম নয়। বহু ছোট বড় মণ্ডপ এবং গৃহপুজোয় কালী, শ্যামা বা জগদ্ধাত্রী প্রতিমার চাহিদা থাকে। আবার কিছু পরিবার বিশেষ রকমের প্রতিমা বা থিম অনুযায়ী দেবীর রূপ চান। সেই অনুযায়ী শিল্পীদেরও অভিনব নকশা নিয়ে ভাবতে হয়। অনেক সময় দুর্গার প্রতিমা শেষ না হতেই অর্ডার ধরে রাখতে হয় কালী বা জগদ্ধাত্রীর।
এছাড়া, দুর্গাপুজোর সময় কলকাতায় ভিড় জমা দেশ-বিদেশের ক্রেতারা অনেকেই কুমোরটুলির শিল্পকর্ম, ক্ষুদ্র মূর্তি, মাটির প্রদীপ, পুতুল বা অন্যান্য সাজসজ্জার সামগ্রী কিনে নিয়ে যান। ফলে বিজয়ার পরও এখানকার ব্যবসা থেমে থাকে না। বরং আলোর উৎসব দীপাবলি এবং কালীপুজোকে ঘিরে মাটির প্রদীপ ও শোভাসামগ্রীর বাজারে নতুন চাহিদা তৈরি হয়। সেই সব পণ্য তৈরিতেও এখন কারিগররা সমান ব্যস্ত।
চলতি বছরে আবার বিশেষ চাহিদা লক্ষ্য করা যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব প্রতিমার ক্ষেত্রে। মাটির পাশাপাশি অনেক মণ্ডপ কাঠ, বাঁশ, কাগজ কিংবা কাপড়ের তৈরি প্রতিমার অর্ডার দিয়েছে। প্লাস্টার অফ প্যারিস ব্যবহার কমানোর জন্য প্রশাসনের নির্দেশ মেনে শিল্পীরা নতুন নতুন পরীক্ষামূলক কাজ করছেন। সেই কারণে কুমোরটুলিতে এখন বৈচিত্র্যময় প্রস্তুতির ছবি দেখা যাচ্ছে।
কুমারটুলিতে মা শ্যামার প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত শিল্পীরা
তবে ব্যস্ততার মধ্যেও রয়েছে চ্যালেঞ্জ। মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট, এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দাম নিয়ে দর-কষাকষি শিল্পীদের চিন্তায় রাখে। অনেকেই অভিযোগ করেন, সারা বছরের শ্রম আসলে কয়েক মাসেই গোনা হয়, অথচ কাঁচামালের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তবুও উৎসবের আবহ, শিল্পচর্চার প্রতি ভালোবাসা এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা ঐতিহ্যই শিল্পীদের টিকিয়ে রাখে।
সামনে আলোর উৎসব। তারই প্রস্তুতিতে এখন ঢাকের বদলে হাতুড়ি, তুলির টান আর মাটির গন্ধে মুখর কুমোরটুলি। বিজয়ার বেদনাময় বিদায়ের সঙ্গেই শুরু হয়েছে নতুন প্রত্যাশা, নতুন আনন্দের আগমন। এক উৎসবের পর আরেক উৎসবের সেতুবন্ধনই কুমোরটুলির শিল্পীদের জীবনের মূল সুর। তাই কলকাতার এই শিল্পপল্লি যেন সারা বছরই ‘চলছে পুজো, আসছে পুজো’-র অনন্ত গানে মেতে থাকে।