‘শরিয়ত নয়, সমান অধিকার চাই’—শুকুর দম্পতির সাহসী পদক্ষেপ

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 3 d ago
 অ্যাডভোকেট সি. শু্ক্কুর
অ্যাডভোকেট সি. শু্ক্কুর
 
শ্রীলতা মেনন/ত্রিশূর

মানুষ যাঁকে ‘শুকুর ভকিল’ নামে চেনে, সেই অ্যাডভোকেট সি. শু্ক্কুর ও তাঁর স্ত্রী শীনা শু্ক্কুর কেরালার মুসলিম পরিবারগুলির মধ্যে এক নতুন আন্দোলনের পথিকৃত।
 
তিন কন্যার জনক-জননী শুকুর দম্পতি তাঁদের বিয়ের দুই দশকেরও বেশি সময় পর বিশেষ বিবাহ আইন (Special Marriage Act - SMA)-এর আওতায় পুনরায় বিয়ে নথিভুক্ত করেন। প্রথমবার তাঁদের বিবাহ হয়েছিল মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অধীনে।
 
এই পদক্ষেপ অনেকের কাছে অদ্ভুত বলে মনে হলেও, এর উদ্দেশ্য ছিল কন্যাদের উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা এবং মুসলিম সমাজে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া।
 
অ্যাডভোকেট সি. শুকুর একটি সিনেমায় অভিনয় করছেন

শুকুর  দম্পতি জানতেন মুসলিম পরিবারে উত্তরাধিকারের বেলায় নারীদের কতটা অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। ১৯৩৭ সালের শরিয়ত অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্টের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ধারা মুসলিম নারী-পুরুষদের বিশেষত নারীদের অধিকারকে সীমিত করে। তাই এই সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটাতেই তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নেন।
 
শুকুর নিজের স্ত্রীকেই পুনরায় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, তবে এবার বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে, যা হিন্দু ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে ধর্মীয় আইন এড়িয়ে বিবাহ করার সুযোগ দেয়। এই পুনঃনিবন্ধন তাঁকে বাধ্যতামূলক শরিয়তি আইন থেকে মুক্তি দেয়, ফলে তিনি নিজের তিন কন্যার নামে ইচ্ছাপত্র করতে পারেন।
 
এই পদক্ষেপ ২০২৩ সালে নেওয়া হয় এবং আওয়াজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই ঘটনাটি প্রবল আলোড়ন তোলে এবং আজও কেরালার গ্রামে-গঞ্জে আলোচনার বিষয়। এখন বহু মুসলিম দম্পতি নীরবে নিজেদের বিয়ে পুনরায় নথিভুক্ত করছেন, যদিও কেউ প্রকাশ্যে বলেন না।
 
শুকুরের বক্তব্য, “আমি জনসম্মুখে পরিচিত মানুষ। আমি এটা করেছি সচেতনতা বাড়ানোর জন্য। শরিয়ত অনুযায়ী সন্তানরা কেবল দুই-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি পায়, আর এক-তৃতীয়াংশ যায় ভাই-বোনদের কাছে। তাছাড়া ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকার নেই, ছেলে পেলে ৬৬ শতাংশ, মেয়ে পায় মাত্র ৩৩ শতাংশ।”
 
সি শুকুর, স্ত্রী শিনা তাদের তিন মেয়ের সাথে
 
তিনি আরও বলেন, “প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে বলে, তারা বিশেষ বিবাহ আইনে পুনরায় বিয়ে নথিভুক্ত করেছে, যাতে শরিয়তের উত্তরাধিকার আইন মানতে না হয়। আজই মুখ্যমন্ত্রী অংশ নেওয়া সিপিএমের এক জনসভা থেকে ফেরার পথে অন্তত চারজন আমাকে জানালেন যে তারা তাঁদের দুই কন্যার স্বার্থে এভাবে পুনঃনিবন্ধন করেছেন। এখন এ প্রথা ব্যাপক।”
 
তবে ভয় এখনো কাজ করে, “অধিকাংশ মানুষ শরিয়তের বিরোধিতা করতে ভয় পান। সেমিটিক ধর্মগুলিতে মৃত্যুর পর শাস্তির ভয় দেখানো হয়। কিন্তু যারা কন্যাদের ভবিষ্যৎকে বেশি গুরুত্ব দেন, তারাই নীরবে এ কাজ করেন। কেউ প্রকাশ্যে করেন না।”
 
শুকুর  বলেন, “কোনো পুরুষ মারা গেলে স্ত্রী-সন্তান অসহায় হয়ে পড়ে এবং প্রায়শই মৃতের ভাইদের দয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। এমনকি বাবার গাড়ি বা ফোন ব্যবহার করতেও কাকার অনুমতি লাগে! কিন্তু যদি ঈশ্বর দয়ালু হন তবে কি সন্তানদের এভাবে কষ্টে ফেলবেন? তাই আইনকে সময়ের সাথে পাল্টাতে হবে।
 
তিনি শরিয়ত অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্টে সংশোধন করে মুসলিমদের জন্য শরিয়তকে ঐচ্ছিক করার দাবি তোলেন। “দুবাইতে শরিয়ত ঐচ্ছিক। সেখানে চাইলে সন্তানদের নামে ইচ্ছাপত্র করা যায়। ভারতেও তা সম্ভব হওয়া উচিত,” বলেন তিনি।
 
বিবাহ পুনঃনিবন্ধনের পর স্ত্রী শিনা এবং কন্যাদের সাথে অ্যাডভোকেট সি শুকুর 
 
তবে তিনি মনে করেন SMA-ও পূর্ণ সমাধান নয়, “ধারা ১৫ আমাদের পুনঃনিবন্ধনের সুযোগ দেয়। কিন্তু এ সমাধান সীমিত। বিধবা, বিধুর বা তালাকপ্রাপ্তরা এ সুযোগ পান না। কেবল বিবাহিত দম্পতিরাই পারেন।”
 
নিজের প্রসঙ্গে শুকুর বলেন, “আমার ভাইয়েরা স্বচ্ছল। আমার অর্থের প্রয়োজন তাঁদের নেই। আমার ভগ্নিপত্নীও পুনঃনিবন্ধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা কেবল সমাজে বার্তা দিতে চেয়েছিলাম।”
 
সরকারি পদক্ষেপ নিয়ে তিনি আশাবাদী নন। “একদেশে এত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র যে ইউনিফর্ম সিভিল কোড (UCC) কেবল মুসলিম নয়, বহু সম্প্রদায়কে আঘাত করবে। আর যদি সত্যিই মুসলিম নারীদের সাহায্য করতে চাইত সরকার, তবে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে পরিবর্তন এনে বহুবিবাহ (polygamy) বন্ধ করত। বহুবিবাহ নারীর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে, এটি মানসিক, আর্থিক, শারীরিক নির্যাতন,” তিনি বলেন।
 
শুকুরের দাবি, ১৯৩৭ সালের শরিয়ত অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট সংশোধন করে মুসলিমদের জন্য শরিয়তকে ঐচ্ছিক করা হোক। কারণ এটি বর্তমান অবস্থায় স্ত্রী ও সন্তানের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪, ২১ এবং ১৬ লঙ্ঘন করছে।
 
শরিয়তের অধীনে উত্তরাধিকার
 
*স্বামী মারা গেলে স্ত্রী পান সম্পত্তির ১/৮ ভাগ।
 
*স্ত্রী মারা গেলে স্বামী পান ১/৪ ভাগ।
 
*পিতা-মাতা মারা গেলে ১/৩ যায় ভাইবোনদের কাছে।
 
*অবশিষ্টের ২/৩ ভাগ পান সন্তানরা।
 
শুকুর  পরিবার সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছেন
 
তাঁর বিরুদ্ধে বহু ধর্মীয় বক্তা প্রকাশ্যে বলেন যে শুকুর নাকি ভয়ংকর শাস্তি পাবেন। কিন্তু শুকুর হেসে উড়িয়ে দেন, “আমি আমার উদ্দেশ্যে সফল হয়েছি,” বলেন তিনি।
 
এদিকে কেরালার বিবাহ নিবন্ধন অফিসগুলো ভরে উঠছে মুসলিম দম্পতিদের পুনঃনিবন্ধনে—যা শুকুরের আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করছে।