মথুরাওয়ালাদের হাভেলি: ১০০ বছরের পুরনো সঙ্গীতের গুরুকুল, যেখানে প্রতিটি ইটের মধ্যে সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি
ফরহান ইসরায়েলি/জয়পুর
কেল্লা আর প্রাসাদের জন্য বিখ্যাত গোলাপি নগরী জয়পুর তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণেও সমানভাবে খ্যাত। শহরের প্রতিটি গলি, প্রতিটি মোড়, প্রতিটি দালান যেন অজস্র ইতিহাসের কাহিনি বুকে বয়ে চলেছে। সেই সব ইতিহাসের মাঝেই ঘাটগেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক অমূল্য সম্পদ, মথুরাওয়ালাদের হাভেলি, যাকে আজও অনেকে বলেন “সুরের গুরুকুল”।
এই হাভেলি কেবল ইট-গাঁথুনি নয়, বরং হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, গজল ও কাওয়ালির এক জীবন্ত পরীক্ষাগার, যেখান থেকে সারা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে গেছেন বহু খ্যাতিমান শিল্পী।
আহমদ হুসেন ও মোহাম্মদ হুসেন
পদ্মশ্রী প্রাপ্ত গজলশিল্পী আহমদ হুসেন–মোহাম্মদ হুসেন, বিখ্যাত কাওয়াল সাবরি ব্রাদার্স, হিন্দি ছবির গায়ক সঈদ সাবরি, আমিন–ফারিদ সাবরি, গজলশিল্পী মোহাম্মদ ওকিল, রিয়্যালিটি শো-র প্রতিভাবান আজমত হুসেন কিংবা রেহমান, সবাই এই হাভেলির উঠোনেই বড় হয়েছেন, যেখানে সকাল-সন্ধ্যা প্রতিধ্বনিত হতো রিয়াজের সুর।
কিন্তু আজ সেই হাভেলি তার পুরনো আভা হারিয়েছে। যেখানে একদিন তখনকার পরিবেশ মুখর হতো তবলা ও হারমোনিয়ামের মেলবন্ধনে, আজ সেখানে ভাঙা দেওয়াল, খসে পড়া প্লাস্টার আর নকশাদার বারান্দা থেকে ঝুলে থাকা স্যাটেলাইট ডিশ। শিল্পসাধনার আসন আজ যেন জীবিকার সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত।
ইতিহাস : মথুরা থেকে জয়পুর
প্রায় দুই শতাব্দী আগে, মথুরা ও বৃন্দাবনের কিছু শিল্পী এই হাভেলির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। বিখ্যাত কাওয়াল আমিন সাবরি স্মৃতিচারণায় বলেন, "আমাদের দাদাজান চেন মোহাম্মদ ও জামাল বখশ বৃন্দাবনে গাইতেন। একবার জয়পুরের রাজা বাঁকে বিহারি মন্দিরে গিয়ে তাঁদের গান শুনে এতটাই মুগ্ধ হন যে তাঁদের জয়পুরে ডেকে আনেন। রাজা তাঁদের থাকার জন্য ঘাটগেটের কাছে এক বিশাল হাভেলি উপহার দেন। সেই হাভেলিই আজ ‘মথুরাওয়ালাদের হাভেলি’ নামে পরিচিত।”
এরপর থেকেই হাভেলিটি শিল্পীদের আশ্রয় হয়ে ওঠে। এখানে থাকা শিল্পীরা রাজদরবারে গাওয়ার সুযোগ পেতেন, পুরস্কৃত হতেন, পেতেন রাজার সহায়তা। ধীরে ধীরে এই হাভেলি পরিণত হয় এক অনন্য সঙ্গীতধারায়, যেখানে প্রায় প্রতিটি ঘরেই বাজত সুরের অনুরণন।
বিখ্যাত গায়ক সৈয়দ সাবরি তার দুই ছেলে ফরিদ (বামে) এবং আমিন (ডানে)- এর সাথে
সুরের সাধনা
বিশ শতকের শুরুর দিকে এই হাভেলি হয়ে উঠেছিল সঙ্গীতের মন্দির। ভোর হলেই গলিতে ছড়িয়ে পড়ত রিয়াজের সুর, আর রাত গভীর পর্যন্ত চলত তবলা-হারমোনিয়ামের মেলবন্ধন।
প্রতিটি ঘর ছিল যেন কোনো গুরুজির শ্রেণিকক্ষ। ছোট ছোট শিশুরা গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বসে শিখত সুর, তাল, লয়। সেই কারণেই এই হাভেলি থেকে উঠে আসা শিল্পীরা শুধু জয়পুর নয়, সমগ্র দেশ এবং বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
গজলের জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী আহমদ হুসেন–মোহাম্মদ হুসেনের শৈশবও কেটেছে এই হাভেলির কোলে। তাঁরা বলেন, "আজও স্বপ্নে ভেসে আসে সেই হাভেলির ছবি, ছোট ছোট ঘর, মাঝের উঠোন আর সারাক্ষণ ভেসে আসা রিয়াজের ধ্বনি। সবকিছুই মনে আজও জীবন্ত।”
খ্যাতির পথে
এই হাভেলি কেবল দরবারি শিল্পীই দেয়নি, বলিউডকেও উপহার দিয়েছে অমূল্য কণ্ঠস্বর। সৈয়দ সাবরি প্রথম সাড়া ফেলেছিলেন হিনা ছবির গান “দের না হো জায়ে” দিয়ে। পরে আমিন–ফারিদ সাবরি শাহরুখ খানের পরদেশ ছবির বিখ্যাত কাওয়ালি “নাহি হোনা থা, লেকিন হো গায়া প্য়ার” গেয়ে মন জয় করেন। সির্ফ তুম ছবির “জিন্দা রেহনে কে লিয়ে তেরি কসম” গানটিও তাঁদের কণ্ঠে অমর হয়ে আছে।
অন্যদিকে আহমদ হুসেন–মোহাম্মদ হুসেনের গাওয়া “তেড়ে দর পর দিওয়ানা আয়া” (ভীর-জারা ছবির) সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁদের গজল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়। এজন্যই তাঁদের ভারত সরকার পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে।
‘সা রে গা মা পা লিটল চ্যাম্পস’-এর বিজয়ী আজমত হুসেন
হাভেলি থেকে ওঠা নতুন তারকারা
এই শতবর্ষী হাভেলি আজও নতুন প্রজন্মকে শিল্পী উপহার দিচ্ছে। ‘সা রে গা মা পা লিটল চ্যাম্পস’-এর বিজয়ী আজমত হুসেন এখান থেকেই সুরের শিক্ষা পেয়েছিলেন। তরুণ কিবোর্ডবাদক রেহবর হুসেন কিংবা গায়ক মোহাম্মদ কাসিমও এই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন।
তবে তারা স্বীকার করেন যে পরিবেশ আর আগের মতো নেই। রেহবর বলেন, "আমরা নিজেদের মতো করে কাজ করছি, কিন্তু আসল রিয়াজের অভাব বড্ড বেশি। আজকের দিনে বেঁচে থাকার ভরসা বলতে ব্যক্তিগত টিউশন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আর ছোটখাটো অনুষ্ঠানই।”
জীর্ণ হাভেলি, ভেঙে পড়া ঐতিহ্য
আজ এই হাভেলিতে বসবাস করছে দেড়শোরও বেশি পরিবার। যে প্রাসাদ একদিন ছিল সঙ্গীতসাধনার পীঠস্থান, তা আজ ভেঙে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত। নকশা করা বারান্দাগুলিতে ঝুলছে ডিশ অ্যান্টেনা।
যেখানে একসময় ভেসে আসত রিয়াজের সুর, সেখানে আজ চালু হয়েছে মাদ্রাসা। শিল্পের প্রতি টান এখনও আছে, কিন্তু জীবিকার চাপ আর প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাব সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে টিকিয়ে রাখা কঠিন করে তুলেছে।
‘সা রে গা মা পা’-র বিজয়ী এবং বলিউডের গায়ক মোহাম্মদ ওকিল আজ মুম্বইয়ে গিয়ে বসতি গড়েছেন। অন্যদিকে রেহমান আর আজমত হুসেনের মতো তরুণ শিল্পীরা জয়পুরেই থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
হাভেলি ও জয়পুরের পরিচয়
জয়পুরে আসা প্রায় প্রতিটি পর্যটককে স্থানীয় গাইডরা শোনান এই হাভেলির কাহিনি। তারা বলেন, এখানকার শিল্পীরাই জয়পুরের নামকে বিশ্বদরবারে উজ্জ্বল করেছেন। আজও যখন কোনও ভ্রমণকারী ঘাটগেটের গলিগুলো দিয়ে হেঁটে যায়, তার চোখ থেমে যায় এই হাভেলির সামনে।
মথুরাওয়ালাদের হাভেলির একটি ছবি
হাভেলিতে বসবাসরত মানুষজনও গর্বের সঙ্গে বলেন, "আমরা কয়েক পুরুষ ধরে গান-বাজনাতেই বেঁচে আছি। বিয়ে-শাদি, সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা অর্কেস্ট্রা, সবকিছুই আমাদের জীবিকা। এটাই আমাদের পেশা, এটাই আমাদের পরিচয়।”
হাভেলির ভবিষ্যৎ?
প্রশ্ন হলো, এই হাভেলি কি আবার তার সোনালি দিন ফিরে পাবে? সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান কি এগিয়ে এসে এই ঐতিহ্য রক্ষা করবে? নাকি এটি কেবলই অতীতের স্মৃতি হয়ে পড়ে থাকবে?
তবে এক জিনিস নিশ্চিত, মথুরাওয়ালাদের হাভেলি কেবল একটি স্থাপনা নয়, বরং এক জীবন্ত ঐতিহ্য, যা হিন্দুস্তানি সঙ্গীতকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে এবং জয়পুরকে বানিয়েছে “সুরের রাজধানী”।
আজ দেয়ালগুলো হয়তো জীর্ণ, কিন্তু সুর-লয়ের প্রতিধ্বনি এখনও বেঁচে আছে শিল্পীদের কণ্ঠে, তাঁদের কাহিনিতে, তাঁদের সাধনায়। আর সেই সুরই আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে যাবে চিরকাল।