শ্রীলেখা মেনন / ত্রিশূর
কে এই খাদিজা মুমতাজ?
তিনি কি ২০১০ সালে কেরালা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সেরা কথাসাহিত্য ‘বাসরা’ (অর্থাৎ আবরণহীন নারী)–এর লেখিকা, না কি কোঝিকোড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন সফল স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, না মুসলিম মহিলাদের অধিকারের কর্মী এবং সুপ্রিম কোর্টে মুসলিম পার্সোনাল ল’–এর উত্তরাধিকার আইনকে প্রশ্ন করা আবেদনকারীদের একজন?
তিনি এই সমস্ত পরিচয় একসঙ্গে বহন করেন। একই সঙ্গে তিনি দেশীয় মানবিক বেদি নামক একটি প্ল্যাটফর্মেরও অংশ, যেখানে কেরালার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে তিনি মিলিতভাবে কাজ করেন সম্প্রীতি ও সংলাপ গড়ে তুলতে। তাই তিনি কেরালার অল্প কয়েকজন মুসলিমের মধ্যে অন্যতম, যারা স্থিতাবস্থার বাইরে গিয়ে পরিবর্তনের জন্য কাজ করছেন।
খাদিজা মুমতাজ
তিনি তাঁর চিকিৎসা জীবন ছেড়েছেন এবং আংশিকভাবে তাঁর কথাসাহিত্যের খাতাও বন্ধ রেখেছেন। আজ তিনি এক কর্মী, যিনি মুসলিম মহিলাদের ন্যায়বিচারের জন্য লড়ছেন, এমনকি তাতে মুসলিম মৌলভী বা জামাতে ইসলামী–র মতো সংস্থাগুলির রোষানলে পড়ার ঝুঁকি থাকলেও।
কেরালায় তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম, যারা ব্যক্তিগত আইনে আধুনিকতার আলোকে সংশোধন এনে লিঙ্গসমতার আন্দোলন চালাচ্ছেন। তাঁদের প্ল্যাটফর্মের নাম ফরজেন (FORGEN – Forum for Muslim Women’s Gender Justice)। এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা ইসলামী লিঙ্গ–অধিকারের সংজ্ঞাকে নতুন করে দেখার দাবি তুলছেন।
মুমতাজ বলেন, “কোরআনে ব্যক্তিগত আইনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ন্যায়বিচার। ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলকে ন্যায় দেওয়ার জন্যই তখন মহিলাদের উত্তরাধিকার–অধিকার দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে যা ন্যায়সংগত ছিল, আজ আর তা ন্যায়সঙ্গত নয়। আমরা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছি যাতে সরকার মহিলাদের পক্ষে এই আইনে সংশোধন আনে।”
তবে ফরজেন যেখানে উত্তরাধিকার আইনে সংশোধন চায়, সেখানে তারা সরকারের প্রস্তাবিত অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধী। “সরকার ইউ সি সি–র কথা বলছে, কিন্তু আমরা শুধু আমাদের উত্তরাধিকার আইনে সংশোধন চাই,” বলেন তিনি।
খাদিজা মুমতাজ সংবাদমাধ্যমকে বক্তব্য দিচ্ছেন
তবুও তাঁর হতাশার সুর শোনা যায়, কারণ তাঁদের আবেদন চার বছর পেরিয়েও সুপ্রিম কোর্টে গৃহীত হয়নি।
“ইউসিসি নিয়ে হুমকি অব্যাহত, অথচ আদালত এখনও পর্যন্ত আমাদের আবেদন শোনেনি,” তিনি বলেন।
অন্যদিকে ঘরের ভেতরেই অনেক কাজ বাকি। অধিকাংশ মহিলা তাঁদের অধিকার সম্পর্কেই জানেন না। “তাদের বলা হয়েছে যা কিছু তারা সহ্য করছে, তাই আল্লাহর বিধান, আর তাই পার্সোনাল ল’ মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।” তাই তারা মহিলাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলছেন। “আমরা মহিলাদের বোঝাই তাঁদের অধিকার কী,” তিনি বলেন।
মুমতাজ বোঝান, মুসলিম মহিলারা তাঁদের ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কটা টের পান মূলত পরিবারের পুরুষ মারা গেলে। “যদি বাবা বা স্বামী মারা যান, তবে মহিলার প্রায় কোনো অধিকারই থাকে না। হয় বাবার ভাইরা, নয় স্বামীর ভাই সম্পত্তি দখল করে নেয়। মহিলার একমাত্র বিকল্প থেকে যায় তাদের কাউকেই বিয়ে করা,” তিনি বলেন। “ত্রিপল তালাক বা বহুবিবাহ কেরালায় বড় সমস্যা নয়। আমাদের আসল সমস্যা উত্তরাধিকার আইন। সংসদ যদি আইন সংশোধন না করে, তবে কিছুই বদলাবে না।”
আজ মুসলিম মহিলারা পড়াশোনা করছেন, উপার্জন করছেন, কিন্তু সম্পত্তিতে তাঁদের অধিকার এখনো সীমিত। “এমনকি তারা ইসলাম না মানলেও, আইন তো থাকবে। এই আইনই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সম্পত্তির অধিকার, কেনাবেচার অধিকার,” বলেন তিনি।
খাদিজা মুমতাজ সমাজকর্মের জন্য পুরস্কার গ্রহণ করছেন
তবে ফরজেন–এর কর্মীরা উত্তরাধিকার আইনে সংস্কার চাইলে তাঁদের ‘মুসলিম–বিরোধী’ বলে দাগানো হয়। “আমাদের মহিলাদের বোঝাতে হয় যে তাঁরা কোরআনের বিরুদ্ধে কিছু করছেন না। অনেক মহিলা জানেনই না তাঁদের অধিকার আছে,” বলেন মুমতাজ।
তাঁর উপন্যাস বার্সা প্রকাশের পর ও সক্রিয় কর্মী হওয়ার পরে অনেকেই তাঁকে সতর্ক করেছিলেন যে, তাঁর পরিণতি বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিনের মতো হবে। কিন্তু মুমতাজ বলেন, “আমার এমন কিছু হয়নি।”
তিনি ইসলামোফোবিয়ার বাতাবরণ পরিষ্কার করার চেষ্টা করছেন, যা তাঁর মতে বর্তমান সরকারী ফ্যাসিবাদ দ্বারা সমর্থিত। তাই হিন্দু ও খ্রিস্টান সংস্কৃতি–কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশীয় মানবিক বেদি–র মাধ্যমে চারটি জেলায় সুফি সঙ্গীতের আসর আয়োজন করছেন। এক আলোচনায় তিনি বলেন, “ইসলামোফোবিয়ার বিষ বাতাসকে কলুষিত করছে। আমাদের তা বুঝতে হবে, কারণ খুঁজতে হবে, সমাধান খুঁজতে হবে।”
বাস্তব সমস্যার সঙ্গে লড়াই করতে করতে তাঁর উপন্যাস বার্সা ও নീট্টিযেঝুথুগল–এর চরিত্রগুলো অপেক্ষা করছে তাঁদের স্রষ্টার কাছে। কিন্তু তিনি বলেন, “এখন আমি বড় উপন্যাস লিখতে পারি না, কারণ আমি খুব ব্যস্ত বাস্তব সমস্যার মধ্যে। তাই গল্প, প্রবন্ধ বা নিবন্ধ লিখি, যেগুলো স্বাভাবিকভাবেই আসে।” তাঁর স্বামী তাঁর কাজকে সমর্থন করেন। কিন্তু তিনি নিজেকে কোনো পরিবর্তন–স্রষ্টা বলে মনে করেন না।
“আমি শুধু যা করতে হবে, তাই করছি,” তিনি বিনয়ে বলেন।
একটি অনুষ্ঠানে খাদিজা মুমতাজ
তাঁর পুরস্কারজয়ী মালয়ালম উপন্যাস বার্সা (অর্থাৎ আবরণহীন নারী)–এর পটভূমি সৌদি আরব, যেখানে ডা. মুমতাজ সাত বছর কাজ করেছিলেন। গল্পটি এক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞা (একজন হিন্দু যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন) ও তাঁর মুসলিম চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ স্বামীকে ঘিরে। তারা অভিজ্ঞতা লাভ করে কিভাবে ইসলামী দেশ হলেও পরবাসে তারা পরাধীন ও বঞ্চিত।
তিনি হতবাক হয়ে দেখেন, সেই দেশে মহিলাদের যে দমন চলছে, তা সেই ধর্মের শিক্ষার সঙ্গে মেলে না, যে ধর্ম ভারতে ভিন্নভাবে পালিত হয়।