শ্রী এম : ধর্মের ঊর্ধ্বে এক সাধকের যাত্রা

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 1 d ago
শ্রী মুমতাজ আলি
শ্রী মুমতাজ আলি
 
শ্রীলতা মেনন/ ত্রিশূর

শ্রী মুমতাজ আলি, যিনি তাঁর অনুসারীদের কাছে শ্রী এম নামে পরিচিত, জন্মেছিলেন কেরালার তিরুবনন্তপুরমে এক মুসলিম পরিবারে। ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে, দেশ-কাল অতিক্রম করে কোটি কোটি মানুষের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন তিনি। বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক শিক্ষক হিসেবেই তাঁকে গণ্য করা হয়।

শৈশবেই ছিল তাঁর এক অদম্য কৌতূহল। অস্তিত্বের রহস্য জানার আকাঙ্ক্ষায় পড়াশোনা করেছেন হিন্দু দর্শন, খ্রিস্টধর্ম, গ্রিক দর্শন, সবকিছুই। কিন্তু কৈশোরে তাঁকে টেনে নিয়ে যায় এক গভীর তৃষ্ণা, “আমি কে? কেন এসেছি পৃথিবীতে?” উত্তর খুঁজতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
 
সৎসঙ্গে শ্রী মুমতাজ আলি
 
তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Apprenticed to a Himalayan Master–এ তিনি লিখেছেন হিমালয়ে তাঁর ভ্রমণের কথা এবং বদ্রিনাথে মহেশ্বরনাথ বাবার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কাহিনি। আশ্চর্যের বিষয়, এই সন্ন্যাসী তাঁকে প্রথম দর্শন দিয়েছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে, কেরালার নিজের বাড়ির পেছনে কাঁঠালগাছের নিচে। হঠাৎ আগমন, রহস্যময় বার্তা,“পরে আবার দেখা হবে”,তারপরই হাওয়ার মতো মিলিয়ে যাওয়া, সবকিছু যেন এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা।
 
বদ্রিনাথে পৌঁছে তিনি বাবাজির শিষ্য হওয়ার সংকল্প নেন এবং তিন বছর হিমালয়ের নানা অঞ্চলে তাঁর সঙ্গে থেকে সাধনা করেন। সেই সময় তিনি অনেক অজানা বিষয় যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি থেকে ফিরে পেয়েছিলেন।
 
অন্ধ্রপ্রদেশে নিজের আশ্রমে শ্রী এম
 
আজও শ্রী এম বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে ক্রিয়া যোগ ও ধ্যানচর্চার মাধ্যমে তাঁদের আধ্যাত্মিক যাত্রায় দীক্ষা দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, কারও নিজস্ব বিশ্বাস ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই, কারণ সব ধর্মই একই সত্যের দিকে অগ্রসর হয়।
 
আজও তিনি বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। উপনিষদ, ভাগবত, গীতা ও প্রাচীন শাস্ত্র নিয়ে বক্তৃতা দেন। যখন ভ্রমণে থাকেন না, তখন অন্ধ্রপ্রদেশের মাদনাপল্লেতে তাঁর আশ্রমে সময় কাটান। সেখানেই তিনি আদিবাসী শিশুদের জন্য একটি বিনামূল্যের বিদ্যালয়ও চালান।
 
মদনপল্লীতে আদিবাসী শিশুদের জন্য শ্রী এম পরিচালিত স্কুল
 
নিজের নামের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, এম মানে মানব, তিনি নিজেকে কেবল একজন মানুষ হিসেবেই দেখেন। আবার এম মানে মুমতাজ আলি এবং মধু, যে নামে তাঁর গুরু তাঁকে ডাকতেন। তিনি বিশ্বাস করেন, পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন মধু নামে এক ব্রাহ্মণ যোগী, যিনি মহাবতার বাবার তত্ত্বাবধানে হিমালয়ে কঠোর তপস্যা করছিলেন।
 
সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করেছে। ২০১৪ সালে তিনি Walk of Hope নামে একটি পদযাত্রা শুরু করেন, কন্যাকুমারী থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত। গ্রামে গ্রামে তিনি মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এবং গীতা-র মূল বাণী শোনাতে ভোলেননি, “দেবত্ব প্রতিটি আত্মার ভেতরেই বিরাজমান।” তিনি বারবার উচ্চারণ করেন গীতার সেই অংশ, যেখানে কৃষ্ণ বলেছেন, যিনি ইন্দ্রিয়জয়ী, সব অবস্থায় শান্ত, এবং অন্যের মঙ্গল কামনায় জীবন যাপন করেন, তিনিই ভক্তদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
 
রাষ্ট্রপতি রামনাথ কবিন্দের কাছ থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার গ্রহণ করার একটি দৃশ্য

গুরু সম্বন্ধে তিনি বলেন, “আপনি হয়তো তাঁকে চিনতে পারবেন না, কিন্তু তিনি নীরবে আপনাকে পথ দেখান। প্রকৃত গুরু আসলে ঈশ্বর নিজেই, যিনি নানা রূপে ভক্তকে সঠিক দিকনির্দেশ দেন।” তাই তিনি নিজেকে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিতে মানুষকে উপদেশ দেন এবং বরং তাঁর শেখানো সাধনা চর্চার ওপর জোর দেন।
 
বর্তমানে ৭৫ বছর বয়সেও শ্রী এম বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করে চলেছেন মানবভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বজনীন একত্বের বাণী প্রচার করতে। তাঁর এক অনন্ত মন্ত্র: *“একং সত্যং বিপ্রা বহুধা বদন্তি, *সত্য এক, জ্ঞানীরা তাকে নানা নামে আখ্যায়িত করেন। হিন্দু ও মুসলিম দুই ধারার সংমিশ্রণ হয়ে তিনি আজ অসংখ্য অনুসারীর কাছে আধ্যাত্মিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।