ইজরায়েলি,জয়পুর
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে, জয়পুরের একটি ছোট ঘরে এক স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল। সেই স্বপ্ন আজ হাজার হাজার মেয়ের শিক্ষার অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়েছে। এটাই মাষ্টার আনোয়ার শ্বাহ নামে স্নেহে পরিচিত সৈয়দ আনোয়ার শ্বাহর গল্প। তিনি শুধুমাত্র নিজের কন্যাকে শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেননি, বরং সেই স্বপ্নকে সমাজের প্রতিটি কন্যার শিক্ষার এক আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন।
আজ তাঁর প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া-তুল আলিয়া কেবল জয়পুরেই নয়, সারা ভারত এবং বিদেশেও জ্ঞান ও ইসলামিক মূল্যবোধের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। আনোয়ার শ্বাহ এমন এক ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন, যেখানে শিক্ষা শুধু বইয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না—বরং চরিত্র গঠন এবং সামাজিক দায়িত্ব নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো।
শিক্ষার আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্প্রতি এক কর্মচারীকে সম্মাননা প্রদান করেন
১৯৮০ সালে তিনি রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান (পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন এবং তারপর শিক্ষার মাধ্যমে সমাজসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।১৯৯৫ সালে কন্যা আলিয়ার জন্মের সময় তিনি এমন একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংকল্প গ্রহণ করেন, যা একটি ইসলামিক পরিবেশে আধুনিক এবং ধর্মীয় উভয় শিক্ষার সমন্বয় ঘটাবে।
১৯৯৫ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আল-জামিয়া-তুল-আলিয়া মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে,যার মধ্যে তিনজন ছিল তাঁর নিজের কন্যা। তাঁর নিজের বাড়ির একটি ছোট ঘরই ছিল প্রথম শ্রেণিকক্ষ। সেই চারটি দেয়ালের ভেতর থেকেই এক শক্তিশালী শিক্ষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে।
প্রথম পর্যায়ে জয়পুরের বহু সম্মানিত পণ্ডিত আনোয়ার শাহর এই শিক্ষাগত উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মেয়ওয়াটের কারী নূর মুহাম্মদ সাহেব, মুফতি ইব্রাহিম, মুফতি জাকির নোমানী, মুফতি খালিল আহমেদ, মুফতি ওয়াজিদ উল হাসান, মুফতি আমজাদ আলী এবং হাজী আব্দুল কাদিম প্রমুখ। তাঁরা শুধু আনোয়ার শাহকে উৎসাহ দেননি, বরং এই মহান উদ্যোগের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধাও নিবেদন করেছিলেন।
উর্দু ভাষায় পাঠ্যবই প্রস্তুত করা হয়, এবং এমন একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয় যাতে ছাত্রীদের আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী জ্ঞান অর্জনেরও সুযোগ থাকে।আজ, এই প্রতিষ্ঠানটিতে ১৫০০‑এরও বেশি ছাত্রীকে পাঠদান করা হচ্ছে। এখানে তিনটি মূল পাঠ্যক্রম চালু রয়েছে,পাঁচ বছরের আলিমা পাঠ্যক্রম,দুই বছরের দীনিয়াত সার্টিফিকেট কোর্স (DCC), এবং এক বছরের দারস-ই-দীন কোর্স।
বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সৈয়দ আনোয়ার শাহ
ছোট মেয়েদের থেকে শুরু করে বিবাহিত মহিলারাও সকল বয়সের ছাত্রী এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে সক্ষম। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি,বিদ্যালয়টি এনআইওএস (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওপেন স্কুলিং)–এর মাধ্যমে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার সুযোগও প্রদান করে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে কোনো মেয়ে যেন ১৮ বছরের আগেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য না হয়।
সৈয়দ আনোয়ার শাহ এমন একটি প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেছেন যা তাঁর অনুপস্থিতিতেও কার্যকরভাবে চলে। তিনি প্রায়ই বলেন,"ভালো প্রশাসক সেই, যে দায়িত্ব অর্পণ করতে জানে এবং সময়মতো তার মূল্যায়নও করে।"তাঁর নেতৃত্বদানের মূলনীতি হলো:"কাজ শুধু সময়মতো নয়, বরং সময়ের আগেই সম্পন্ন হওয়া উচিত।"এই শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের কারণেই প্রতিষ্ঠানটি এত সুসংগঠিত ও দক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
বছর বছর ধরে এই শিক্ষামূলক যাত্রা থেকে বহু সফল মহিলা বেরিয়ে এসেছে। কেউ কেউ প্রকৌশলী হয়েছেন, কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছেন। অন্যদিকে অনেকেই কোরআন ও আরবি শিক্ষায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা ভারতের পাশাপাশি বিদেশে প্রায় ১৫০টি মাকাতিব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে এসেছে।
এছাড়াও,সৈয়দ আনোয়ার শাহের একজন শিষ্য মদিনা শরীফেও অবস্থান করেন, যেখানে তিনি প্রতিদিন নবীর রোজার নামাজ পড়েন এবং মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার এই উদার মিশনকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন।শিক্ষার পাশাপাশি আনোয়ার শাহের সামাজিক সেবার কাজও উল্লেখযোগ্য। ২০০২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি জয়পুরের জামা মসজিদের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ে তিনি মসজিদের আয় বহুগুণ বৃদ্ধি করে সমাজকল্যাণে তা ব্যবহৃত করেছেন।
আল-জামিয়াতুল আলিয়ার ছাত্রী
তাঁর পথ প্রদর্শক নীতি সবসময় ছিল,“আমাকে আল্লাহ থেকে নিতে হবে এবং সমাজকে দিতে হবে।”এই বিশ্বাসকে সামনে রেখে তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেছিলেন।২০০৬ সালে তিনি ইছলাহুল মমিনাত নামে একটি বিশেষ আলোচনা পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা খুব দ্রুত মুসলিম মহিলাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে পরিণত হয়। আজ এই পত্রিকা রাজস্থানের ১৮টি জেলারও বেশি এবং প্রায় ২৩টি জেলার পাঠকের কাছে পৌঁছেছে।
এখানে মহিলাদের বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে ইসলামিক শিক্ষা উপস্থাপন করা হয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে মুসলিম মহিলারা একটি নতুন পরিচয় লাভ করেছে ভাবতে পারা,বুঝতে পারা এবং সমাজে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার সুযোগ।মাওলানা কাছিম নীলখেড়ি, মুফতি কিফায়াতুল্লাহ গুজরাটি, মাওলানা তালহা মাজাহিরী, মুফতি ফারুক মীরাথী, মাওলানা খালিদ গাজীপুড়ীসহ দেশের অনেক মহান পণ্ডিত আল-জামিয়া-তুল আলিয়ার সমর্থন ও আশীর্বাদ লাভ করেছেন। সকলেই এই প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করেন এবং এর সফলতার জন্য প্রার্থনা করেন।
আনোয়ার শাহ প্রায়ই বলেন,“কোরআন বা হাদিস থেকে যদি আপনি এক কথাও শিখে থাকেন, তবে তা অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।”তাঁর মিশন হলো হজরত আয়েশার পথ অনুসরণ করে জ্ঞান বিস্তার এবং সমাজের উন্নতি সাধন করা। তাঁর মতে, কন্যা শিশুরা উপযুক্ত শিক্ষা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা সমাজকে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং নিজেদের পরিবার ও পুরো সমাজে সংস্কার আনতে সক্ষম হয়।
আজ আল-জামিয়া-তুল আলিয়া শুধুই একটি মাদ্রাসা নয়—এটি একটি আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এটি ছাত্রীদের সম্পূর্ণ শিক্ষা প্রদান করে, ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় ঘটায় এবং সমাজে একটি প্রভাবশালী স্থান অর্জন করতে সহায়তা করে।শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে আলো আনতে চাওয়া যেকোনো ব্যক্তির জন্য সৈয়দ আনোয়ার শাহর এই যাত্রা একটি অনুপ্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত।
একটি ছোট ঘর থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা আজ হাজার হাজার হৃদয় ও মনের পথপ্রদর্শনে পরিণত হয়েছে এবং এই মিশন এখনো বেড়েই চলেছে।