ফারহান ইসরাইলি / জয়পুর
ভারতের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলার ভাণ্ডারে রাজস্থানি ক্ষুদ্রচিত্র এক অনন্য অধ্যায়। আর এই শিল্পের পরিচিত মুখ হিসেবে আজ যাঁর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন সৈয়দ শাকির আলি। দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় তিনি শুধুমাত্র রাজস্থানের ঐতিহ্যকেই যে নতুন প্রাণ দিয়েছেন তা-ই নয়, বরঞ্চ ক্ষুদ্রচিত্র শিল্পকে পৌঁছে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আসনে।
শাকির আলির শিল্পযাত্রা শুরু হয়েছিল শৈশবেই। ছোট্ট ছেলেবেলায় তিনি কয়লা দিয়ে দেওয়ালে আঁকিবুঁকি কাটতেন, নাপিতের দোকানে অপেক্ষা করতে করতে বলপয়েন্ট কলম দিয়ে মানুষের প্রতিকৃতি আঁকতেন, তখন হয়তো তিনি ভাবতেই পারেননি যে এই সহজ শখ একদিন তাঁকে এনে দেবে দেশের সর্বোচ্চ শিল্পসম্মান।
শাকির আলি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পদ্মশ্রী সম্মান গ্রহণের একটি দৃশ্য
বিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি চক ও রঙ দিয়ে রঙোলি বানাতেন, আর প্রতিটি অঙ্কন প্রতিযোগিতায় জয় করতেন। শিল্প যেন তাঁর রক্তেই বইছিল। তাঁর দাদু সৈয়দ হামিদ আলি ছিলেন আওধ স্কুলের প্রখ্যাত চিত্রকর ও শিক্ষক, আর তাঁর বাবা বিরল চিত্রকলা ও ঐতিহাসিক সামগ্রীর ব্যবসায়ী। এই শিল্পানুবৃত্তিই শাকিরের মনে শিল্পের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা জাগিয়েছিল।
১৯৫৬ সালে উত্তরপ্রদেশের জালেসর গ্রামে জন্ম নেওয়া শাকির আলির পরিবার পরে জয়পুরে চলে আসে। সেখানেই তাঁর শিল্প প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। এখান থেকেই তিনি রাজস্থানি ক্ষুদ্রচিত্র শিল্পকে নতুন দিশা দেন এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেন। তাঁর আজীবন অবদানকে সম্মান জানিয়ে তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
পদ্মশ্রী সম্মানপ্রাপ্তদের দলভুক্ত শাকির আলির একটি ছবি
শাকির আলির ক্ষুদ্রচিত্রে গভীর সম্পৃক্ততা শুরু হয় এক আকস্মিক সাক্ষাতের মাধ্যমে। পরিবারের বন্ধু ও শিল্পী পদ্মশ্রী রামগোপাল বিজয়বর্গীয়র স্টুডিওতে গিয়ে তিনি কিষণগড় শৈলীর ক্ষুদ্রচিত্র সম্পর্কিত বই খুঁজে পান। মুগ্ধ হয়ে তিনি সেগুলির অনুলিপি আঁকতে শুরু করেন। তাঁর প্রাকৃতিক প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিজয়বর্গীয় তাঁকে নিয়ে যান ভেদপাল শর্মার কাছে, যিনি ‘বন্নু জি’ নামে পরিচিত, জয়পুর রাজদরবারের কিংবদন্তি ক্ষুদ্রচিত্র শিল্পী। প্রায় তিন বছর বন্নু জির কঠোর প্রশিক্ষণে শাকির এই সূক্ষ্ম শিল্পে পুরোপুরি দক্ষ হয়ে ওঠেন।
যদিও তাঁর বাবা-মা চেয়েছিলেন তিনি ডাক্তার হোন, এবং জীববিজ্ঞানে তিনি সবসময় সেরা ফল করতেন, তবু তাঁর হৃদয় ছিল অন্যত্র। তাঁর জীববিজ্ঞানের চার্ট এতটাই শিল্পসম্মত হত যে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতত। অবশেষে তিনি শিল্পকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন, বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সম্পূর্ণভাবে ক্ষুদ্রচিত্রের সাধনায় নিমগ্ন হন।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী গেহলট শাকির আলিকে সংবর্ধনা জানানোর একটি দৃশ্য
শাকির আলির কাছে ক্ষুদ্রচিত্র মানে শুধু আকারে ছোট নয়, এটি সূক্ষ্মতার শিল্প। তিনি জানান, মাত্র ১২ থেকে ১৬ ইঞ্চির কাগজে তিনি আঁকেন চোখের পাতা, ত্বকের টেক্সচার, পাখি, গাছ, ফুল, পাহাড়-পর্বত, যা দেখতে অনেক সময় লুপ ব্যবহার করতে হয়। তাঁর মতে, “শিল্প শেখানো যায় না, তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। কেউ শিখতে বছরের পর বছর নেয়, আবার কেউ কয়েক দিনেই রপ্ত করে ফেলে।” ধৈর্য, নিষ্ঠা আর অবিরাম সাধনাই এই শিল্পে সিদ্ধি এনে দেয়।
১৯৯২ সালে ইসলামাবাদে দশম সার্ক লোকোৎসবে তিনি ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেন এবং প্রথম পুরস্কার জেতেন। এর পরের বছর তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত হন। তারপর থেকে তিনি প্রায় ১৫টি দেশে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, ইরান, তুরস্ক, আলজেরিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেনসহ সাতবার দুবাইতে। বহুবারই তিনি সেখানে সর্বোচ্চ সম্মান অর্জন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনও সুশোভিত তাঁর ছবিতে, আবার বিদেশি অতিথিদের উপহার হিসেবেও তাঁর আঁকা চিত্র দেওয়া হয়েছে।
শাকির আলি তার পরিবারের সাথে
বছরের পর বছর তিনি সারা বিশ্বে লাইভ ডেমোনস্ট্রেশন করেছেন, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ছবি এঁকেছেন দর্শকদের সামনে। দুবাইয়ের মতো জায়গায় যেখানে শিল্পকর্মের বিক্রি কম, সেখানেও তাঁর ছবি আরব দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।
এখন ৭১ বছর বয়সেও তিনি সমান উদ্যমী ও সৃজনশীল। বর্তমানে তিনি একটি কফি টেবিল বই প্রস্তুত করছেন, যেখানে তাঁর শিল্পকর্ম, ব্রাশের টেকনিক, রঙের ব্যবহার ও ভিডিও টিউটোরিয়াল থাকবে। তাঁর আশা, নতুন প্রজন্ম, বিশেষত শিশুরা, এটি থেকে শিখে এই প্রাচীন শিল্পকে আবার জীবিত করবে।
ক্ষুদ্রচিত্র আঁকায় নিমগ্ন শাকির আলির একটি ছবি
এ শুধু এক প্রতিভাবান শিল্পীর কাহিনি নয়, এক দূরদর্শীর যাত্রা। শাকির আলি শুধু রাজস্থানি ক্ষুদ্রচিত্রকে সংরক্ষণই করেননি, তিনি এটিকে নতুনভাবে কল্পনা করেছেন এবং বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন, সাদামাটা জীবন, বিনয় আর অক্লান্ত নিষ্ঠার মাধ্যমে। ২০১৩ সালে পদ্মশ্রী ও ২০২১ সালে ক্রেডেন্ট রত্ন সম্মান তাঁর জীবনের উজ্জ্বল স্বীকৃতি।
সৈয়দ শাকির আলি কেবল ক্ষুদ্রচিত্রের একজন শিল্পী নন, তিনি এর রক্ষক ও নবস্রষ্টা। প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রেখে আধুনিক প্রেক্ষাপটে তিনি একে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। পদ্মশ্রী ও অন্যান্য সম্মান তাঁর যাত্রার নিদর্শন হলেও, তাঁর প্রকৃত কৃতিত্ব এই যে তিনি বিশ্ববাসীর সামনে ভারতীয় ক্ষুদ্রচিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাতে আগামী প্রজন্মও এর মাধুর্যে অনুপ্রাণিত হয়।