ধর্ম ও সঙ্গীতের সীমানা পেরিয়ে বতুল বেগমের পদ্মশ্রী অর্জন

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 8 d ago
বতুল বেগম
বতুল বেগম
 
অনিকা মহেশ্বরী / নয়াদিল্লি

ভারতের শাস্ত্রীয় ও লোকসঙ্গীতের ভুবনে বতুল বেগম এক অনন্য নাম। তিনি শুধু সুরের সাধিকা নন, বরং জীবন্ত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। জীবনের পথে নানা বাধা-বিপত্তি, দারিদ্র্য ও সামাজিক সংকটকে অতিক্রম করে তিনি গানের মাধ্যমে নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছেন। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত তাঁর প্রাণের সাথী, আর সেই অনুরাগই আজ তাঁকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
 
রাজস্থানের নাগৌর জেলার কেরাপ গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া বতুল মিরাসি সম্প্রদায়ভুক্ত, যাদের ঐতিহ্য সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত। আওয়াজ–দ্য ভয়েস–কে তিনি জানিয়েছিলেন যে মাত্র আট বছর বয়সেই তিনি ভজন গাওয়া শুরু করেছিলেন। শৈশব থেকে ভজন গাওয়ার এই ভক্তি একদিন তাঁকে এনে দেয় “ভজনের বেগম” উপাধি, যা শিল্পের মাধ্যমে ধর্মীয় অন্তর্ভুক্তির প্রতি তাঁর অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে।
 
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু- র থেকে পদ্মশ্রী গ্রহণ করার একটি দৃশ্য

যতদিন অনুমতি ছিল, বতুল স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন, কিন্তু মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তবুও তিনি তাঁর অনুরাগ ছাড়েননি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও, তাঁর সঙ্গীতপ্রেম কখনো থেমে যায়নি। এক গ্রাম্য কন্যা থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লোকশিল্পীতে উত্তরণের পথটি ছিল তাঁর দৃঢ়তা ও অধ্যবসায়ের প্রতিচ্ছবি।
 
বিশ্বজুড়ে, যা মূলত একটি ঐতিহ্যবাহী রাজস্থানি লোকসঙ্গীত ধারা, এই গাওয়ার মাণ্ড জন্য তিনি প্রসিদ্ধ। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, টিউনিসিয়া ও জার্মানি সহ ৫৫টিরও বেশি দেশে তিনি মাণ্ড পরিবেশনা করেছেন। তাঁর কাজ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং ২০২২ সালে তিনি নারী শক্তি পুরস্কার পান। ফ্রান্স ও টিউনিসিয়ার সরকারও তাঁকে সম্মানিত করেছে।
 
বতুলের পরিবেশনা সর্বত্র শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। মাণ্ড, ভজন ও অন্যান্য লোকধারায় তাঁর দখল ভারতের সঙ্গীত ঐতিহ্যকে জীবন্ত করে তোলে। তিনি বলেন, “মাণ্ড গাওয়া সহজ নয়। এর অনেক জটিলতা আছে। যারা এ শিল্প শিখেছে তারাই এর গভীরতা বোঝে। আমি অন্যদের শুনে শিখেছি। আমি গানকে এত ভালোবাসি যে খাওয়া ছাড়লেও রেওয়াজ বাদ দিই না।”
 
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছ থেকে  বাতুল বেগমের নারী শক্তি পুরস্কার গ্রহণ করার একটি দৃশ্য 
 
তাঁর কণ্ঠ ও নিষ্ঠা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভেদরেখা পেরিয়ে মানবতা ও সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। বতুলের মতে, “মাণ্ড রাজস্থানের লোকসঙ্গীত। আল্লা জিলাই বাই-এর মতো মহৎ শিল্পীরা এটিকে কালজয়ী করে তুলেছেন। রাজস্থানের রাজকীয় দরবারের সৃষ্টিগুলো আমাদের সমৃদ্ধ সঙ্গীত ঐতিহ্যের অন্তর্দৃষ্টি দেয়।”
 
তাঁর স্বামী ফেরোজ খান রাজস্থান স্টেট রোডওয়েজে কন্ডাক্টর ছিলেন। তাঁদের তিন পুত্র ছিল। গৃহস্থালির দায়িত্ব সামলিয়েও বতুল নিজের সঙ্গীতচর্চা চালিয়ে গেছেন। তিনি ঢোল, ঢোলক ও তবলার মতো বাদ্যযন্ত্র বাজাতেও শিখেছেন, যা তাঁর সঙ্গীতভাষাকে আরও প্রসারিত করেছে।
 
ছোট সম্প্রদায়িক আসর থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উঠে আসার তাঁর এই যাত্রা তাঁর অবিচল সাধনার নিদর্শন। তিনি আন্তর্জাতিক ফিউশন ফোক ব্যান্ড বলিউড ক্লেজমার-এর সদস্য ছিলেন, যেখানে নানা সংস্কৃতি ও ধর্মের শিল্পীরা একত্রিত হয়েছিলেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তিনি সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন।
 
প্যারিসের একটি অনুষ্ঠানে বাতুল বেগম 
 
তাঁর কাজ প্রমাণ করে যে সঙ্গীত এক সর্বজনীন ভাষা, যা বিভাজন নয়, বরং সেতুবন্ধন তৈরি করে। ফ্রান্স ও টিউনিসিয়ার সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বতুল বেগম তাঁর পরিবেশনার মাধ্যমে সহিষ্ণুতা ও ঐক্যের কণ্ঠে পরিণত হয়েছেন। তিনি মেয়েদের শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে প্রশ্ন করেন,তিনি বিশ্বাস করেন যে সঙ্গীত সামাজিক পরিবর্তনের এক মাধ্যম হতে পারে।
 
২০২১ সালে বতুল বেগম তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দের কাছ থেকে নারী শক্তি পুরস্কার গ্রহণ করেন। তাঁর অবদান আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠানেও স্বীকৃতি পেয়েছে। একক পরিবেশনা ও ব্যান্ডের মাধ্যমে তিনি আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, টিউনিসিয়া, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানিতে শান্তি ও বহুত্ববাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
 
যা তাঁকে সত্যিই আলাদা করে তোলে তা হলো, একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হয়েও তিনি হিন্দু ভজন গান গেয়ে থাকেন। তাঁর কথায়, “আমরা সম্প্রদায়ের ভেদ দেখি না। শিল্প ও সঙ্গীতে সব দেবদেবী সমান ও শ্রদ্ধার যোগ্য।” 
 
প্যারিসের আইফিল টাওয়ারের সামনে ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে বাতুল বেগম
 
তাঁর এই বিশ্বাস গঙ্গা-যমুনা শিষ্টাচারের প্রতিধ্বনি, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক যৌথ সাংস্কৃতিক দর্শন। বতুল মনে করেন, সঙ্গীত সেই পবিত্র সুতোর মতো, যা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভেদরেখা অতিক্রম করে মানবতাকে বাঁধে। “শুধু শিল্প ও সঙ্গীতের মাধ্যমেই আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে পারি। এটাই আমার বার্তা: বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।”
 
আজ বতুল বেগম কেবল একজন খ্যাতিমান শিল্পীই নন, তিনি প্রগতিশীল মূল্যবোধেরও দূত। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি গানের মাধ্যমে সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রচার করেছেন। তাঁর যাত্রা প্রমাণ করে সঙ্গীত ধর্ম বা জাতের সীমানা মানে না। তিনি সহিষ্ণুতা ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছেন এবং এখন তরুণ শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজের উত্তরাধিকার পৌঁছে দিচ্ছেন।
 
তাঁর নিজের ভাষায়, “সঙ্গীতই পূজা, রেওয়াজই সাধনা, আর সুরই আত্মার স্বর।”