"আত্ম আবিষ্কার থেকে সামাজিক পরিবর্তন: যোগ গুরু নাঈম খানের অনন্য যাত্রা"

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 11 d ago
যোগগুরু নাঈম খান
যোগগুরু নাঈম খান
 
মোহাম্মদ ফারহান ইস্রাইলি / জয়পুর

রাজস্থানের মরুভূমির বুকে, যেখানে সূর্যোদয়ের আলো প্রাচীন দুর্গের প্রাচীরে ঝলমল করে ওঠে, সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল এক অনন্য যাত্রা। একজন সাধারণ মানুষ থেকে এক বৈশ্বিক যোগগুরুর রূপান্তর, নাঈম খানের এই জীবনকথা হলো দৃষ্টি, সাহস আর অন্তর্জাগরণের গল্প।আজ তিনি শুধু একজন যোগশিক্ষক নন, বরং এক দূত, যিনি যোগকে করেছেন সীমান্ত ও ধর্ম অতিক্রমী এক সর্বজনীন ভাষা।

রাজস্থানের সাংস্কৃতিক হৃদয়স্থল জোধপুরে জন্ম নাঈমের। জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এক পুরনো বন্ধু, যিনি সন্ন্যাসজীবন বেছে নিয়েছিলেন, তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন শক্তি ও প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে গড়া এক দর্শনের সঙ্গে। বন্ধুর আশ্রমে বিড়াল, টিকটিকি আর পাখিদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখে নাঈম বিস্মিত হন। তাঁকে বলা হয়েছিল, এই প্রাণীরা এক “শক্তি”-র প্রভাবে থাকে। ঠিক সেখান থেকেই জাগে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি, নিজেকে জানার, আর জীবনের গভীর অর্থ খোঁজার তৃষ্ণা।
 
যোগগুরু নাঈম খানের যোগ অনুশীলনের একটি মুহূর্ত
 
আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানীশ গোয়েল তাঁকে উপহার দেন বাবা রামদেবের আসন, প্রণায়াম, মুদ্রা ও বন্ধ গ্রন্থ। সেখান থেকেই শুরু নাঈমের যোগযাত্রা। পরে তিনি মঙ্গলোরে গুরুকরুণাকরজি (বিখ্যাত যোগগুরু বি.কে.এস. আয়ঙ্গারের শিষ্য)-র কাছে চিকিৎসামূলক যোগ অধ্যয়ন করেন। নিয়মিত সাধনার মধ্য দিয়ে নাঈম খুঁজে পান মানসিক শান্তি, আর জীবনের সুস্পষ্ট লক্ষ্য।
 
২০১৩ সালে তিনি জোধপুরের ঐতিহাসিক মেহরানগড় দুর্গে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর যোগ বিদ্যালয় কার্মা ওয়ার্ল্ড। এটি কেবল যোগশিক্ষার কেন্দ্র নয়, এখন তা ভারতীয় সংস্কৃতি, সংগীত, শিল্পকলা ও মননশীলতার মিলনক্ষেত্র। ভারত ও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন কার্মা ওয়ার্ল্ডে, যেখানে নাঈম এবং তাঁর ছেলে যোগগুরু নাউদ খান তাঁদের ৯০ মিনিটের সেশনে আসন, প্রণায়াম ও ধ্যানের মাধ্যমে মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে দিতে পথপ্রদর্শন করেন।
 
তিনি জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে কর্মশালা পরিচালনা করেছেন, যেখানে যোগকে ধর্ম নয়, বরং বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন। ২০১৩ সালে তিনি মেহরানগড় দুর্গে প্রথম আন্তর্জাতিক যোগ ও সংগীত উৎসবের আয়োজন করেন, যেখানে দেশ-বিদেশের যোগগুরু ও শিল্পীরা অংশ নেন। ২০১৫ সালে তাঁকে জার্মানিতে “প্রথম মুসলিম যোগগুরু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
 
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সাথে যোগগুরু নাঈম খান
 
দুই বছর পর, ২০১৭ সালে ইউরোপের খ্যাতনামা অ্যাকাডেমি অব কালচার NWR তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় ভারতীয় যোগ ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে বক্তৃতা ও কর্মশালা পরিচালনার জন্য। সেখানে তাঁর চক্র-চিকিৎসা, ধ্যান ও চোখ বাঁধা যোগসেশন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের গভীর স্বচ্ছতা, একাগ্রতা ও শক্তির অভিজ্ঞতা দিয়েছে।
 
নাঈমের কাছে যোগ কেবল শরীরচর্চা নয়, এটি আত্মার শৃঙ্খলা। তিনি প্রায়ই বলেন, “যোগ জীবনের যন্ত্রণা দূর করে, আর ভরে দেয় শক্তি, উদ্যম ও সমতায়।” যোগকে সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা দিতে তিনি রমজান মাসে চালু করেন “রোজায় যোগ” কর্মসূচি। মৌলানা আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপবাসরত মানুষদের তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস অনুশীলন শেখান। তাঁর ভাষায়, “সঠিক শ্বাস ক্লান্তি দূর করে, আর উপবাসের মাঝেও নতুন সতেজতা আনে।”
 
২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক যোগ দিবসে তিনি ও তাঁর ছেলে বিশেষ যোগসেশন পরিচালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয় ও কার্মা যোগ জীবন ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে। শতাধিক মানুষ অংশ নেন, হস্ত উত্তানাসন, শশাঙ্কাসন, ভূজঙ্গাসন, মেরুদন্ডাসন, নাড়িশোধন প্রণায়াম, ভ্রামরী, ও মকরাসনের মতো আসনের মাধ্যমে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও মানসিক স্থিতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে।
 
যোগ শিক্ষক নাঈম খান শিক্ষার্থীদের যোগাসন শেখাচ্ছেন
 
কেবল স্বাস্থ্য নয়, নাঈমের মিশন বিস্তৃত। তিনি ভারতীয় হস্তশিল্প, পরিবেশবান্ধব কর্মকাণ্ড ও সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রচার করেন। রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চলে বিদেশি গাছের বদলে দেশীয় প্রজাতি লাগানোর প্রচার করেছেন। ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার শিল্পীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সহযোগিতাও গড়ে তুলেছেন।
 
সংগীত তাঁর রক্তে বহমান। তাঁর দাদা উস্তাদ উমরদীন খান ছিলেন জোধপুর রাজপরিবারের দরবারি সংগীতজ্ঞ। তাঁর মামা, পদ্মভূষণ উস্তাদ সুলতান খান, জর্জ হ্যারিসন ও দ্য বিটলস-এর মতো বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে সরোদ বাজিয়েছেন। তাঁদের বংশে উস্তাদ মৌলা বকশ ও আল্লাহ বকশের মতো সংগীতগুরু ছিলেন। কিন্তু সময়ের স্রোতে পরিবারে সংগীত ম্লান হতে থাকে। তাঁর বাবা নিযামউদ্দিন খান বেছে নেন সমাজসেবা, কাজ করেন শিক্ষাক্ষেত্রে।
 
নাঈম ও তাঁর ভাই প্রথমে কুয়েত, সৌদি আরব ও দুবাইতে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু একাধিক ব্যক্তিগত ক্ষতি, প্রিয় কাকা উস্তাদ নাসির খানের আকস্মিক মৃত্যু এবং দাদির (যিনি ছিলেন খ্যাতনামা আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ও ধাত্রী) প্রয়াণ, তাঁকে গভীরভাবে আঘাত করে। দুঃখে ক্লান্ত নাঈম ঘুমের ওষুধ বা ধর্মীয় গ্রন্থে সান্ত্বনা পাননি। তিনি বলেন, “সব ধর্মই বলে, প্রশ্ন কোরো না, কেবল বিশ্বাস করো। কিন্তু আমার মন তা মানতে প্রস্তুত ছিল না।”
 
যোগগুরু  নাঈম খানের বিদেশে যোগ ব্যায়াম শেখানোর একটি মুহূর্ত
 
তবুও নিজের ধর্মবিশ্বাসে দৃঢ় থেকে নাঈম কখনো গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননি। তাঁর মতে, “যদি তুমি বিশ্বাসে সততার সঙ্গে বাঁচো, তবে তুমি নিজেই একজন যোগী।” নানা হুমকি ও মৌলবাদী সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি মুসলিম সমাজসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ে যোগ প্রচার করেছেন, যাঁরা আজ তাঁর অবদানকে মূল্য দিচ্ছেন।
 
তাঁর যোগচর্চার ধরন কেবল আসনভিত্তিক নয়, এটি এক সচেতন জীবনদর্শন। তিনি উপদেশ দেন, “খারাপ খবর এলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দিও না। প্রথমে শ্বাসের দিকে মন দাও। সেখান থেকেই শুরু হয় ধ্যান।”
 
তাঁর প্রিয় আসনগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রেয়ার পোস, রেইজড হ্যান্ডস পোস, নোজ টু নীজ ও শবাসন, যা চাপ কমায় ও শরীরকে নমনীয় করে। তিনি তাঁর গুরু বাবা বিজয়বাস্ত শেখানো দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস কৌশল দৈনন্দিন অভ্যাসে যুক্ত করেছেন, যা শরীরকে উদ্দীপিত করে। নাঈম মনে করেন, প্রত্যেকেরই সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন যোগ ও ধ্যান করা উচিত সামগ্রিক সুস্থতার জন্য।
 
একটি ধ্যান কর্মসূচি পরিচালনায় যোগগুরু নাঈম খান 
 
আজ ৪৯ বছর বয়সে নাঈম খান আত্ম-আবিষ্কারকে রূপান্তর করেছেন সামাজিক পরিবর্তনের মিশনে। তাঁর ২৪ বছর বয়সী ছেলে নাউদ এই উত্তরাধিকার বহন করছেন, আর তাঁর মেয়ে যোগের সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটাচ্ছেন। নাঈম ফ্রান্সের উপ-রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সুপারমডেল নাওমি ক্যাম্পবেল পর্যন্ত বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে যোগ শিখিয়েছেন। তবুও তাঁর বিনম্র উক্তি, “আমার নাম নয়, যোগের নাম পরিচিত হোক।”
 
যোগগুরু নাঈম খানের যাত্রা নিছক ব্যক্তিগত নয়, এটি এক দর্শনের উত্থান, যা যোগকে বৈশ্বিক সম্প্রীতির সেতু হিসেবে দেখে। জোধপুরের মাটিতে জন্ম নেওয়া এই যোগী আজ বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন শান্তি, সুস্থতা ও ঐক্যের বাণী। তাঁর যাত্রা আমাদের শেখায়, বিশ্বাসে টিকে থেকে, প্রশ্ন করতে ভয় না পেয়ে, যোগকে জীবনের অংশ করলে মানুষ নিজেকেই বদলে দিতে পারে, আর সেই পরিবর্তন ছড়িয়ে দিতে পারে সমগ্র বিশ্বে।