“ভগ্ন ইতিহাসে নতুন প্রাণ, অনুপ্রেরণার নাম মাইমুনা”

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 12 d ago
ভারতের প্রথম মুসলিম নারী শিল্প সংরক্ষক মাইমুনা নার্গিস
ভারতের প্রথম মুসলিম নারী শিল্প সংরক্ষক মাইমুনা নার্গিস
 
ফারহান ইসরাইল / জয়পুর

শিল্প সংরক্ষণ এমন এক ক্ষেত্র যা কেবল ইতিহাসকেই রক্ষা করে না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত রাখে। এই ক্ষেত্রে এক অনন্য নাম হলেন মাইমুনা নার্গিস , যিনি ভারতের প্রথম মুসলিম নারী শিল্প সংরক্ষক হিসেবে নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলেছেন।

তাঁর গল্প কেবল পেশাগত সাফল্যের নয়, বরং আবেগ, সংগ্রাম আর দৃঢ় সংকল্পের, যা ভগ্ন ইতিহাসকে নতুন প্রাণ দিয়েছে। শৈশব থেকেই তাঁর শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল, যা পরবর্তীতে তাঁর জীবনের একমাত্র পথ হয়ে ওঠে।
 
মাইমুনা নার্গিসের দ্বারা কৃষ্ণের একটি চিত্রকর্ম পুনরুদ্ধারের দৃশ্য
 
আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে (এ এম ইউ) ফাইন আর্টস পড়তে গিয়ে তাঁর শিল্পীসত্তা গড়ে ওঠে। তবে এমএফএ-তে ভর্তি হওয়া কঠিন হয়ে পড়ায় তিনি এক বছরের মিউজিওলজি ডিপ্লোমা বেছে নেন, যা তাঁর জীবনের এক নির্ণায়ক বাঁক হয়ে দাঁড়ায়।
 
এই কোর্স তাঁকে নিয়ে যায় দিল্লির জাতীয় জাদুঘরে, যেখানে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে তিনি অনুভব করেছিলেন, এ যেন বইয়ের বাইরে ইতিহাসকে হাতে ছোঁয়ার এক নতুন জগতে প্রবেশ। ২০০২ সালে জয়পুরের ঐতিহাসিক জয়গড় দুর্গে কিউরেটর হিসেবে কাজ শুরু করার মধ্য দিয়েই তাঁর শিল্প সংরক্ষণের যাত্রা শুরু হয়।
 
কিন্তু এ পথ সহজ ছিল না। দিল্লিতে মিউজিওলজি ও কনসারভেশন পড়তে গেলে অনেকেই কটাক্ষ করেছিল, “যেখানে সবাই এ এম ইউ-তে ভর্তির স্বপ্ন দেখে, তুমি উল্টে সেখান থেকে দিল্লি যাচ্ছ?” তখনও সমাজে মিউজিওলজি ও শিল্প সংরক্ষণের বিষয়গুলো অপরিচিত ছিল। তবে তাঁর বাবা–মা মেয়ের স্বপ্নে ভরসা রেখেছিলেন। পরীক্ষার সময় তাঁর মা নিজে দিল্লি গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে।
 
কেইলিং- এ  একটি সংরক্ষণ কর্মশালায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে মাইমুনা নার্গিস
 
নার্গিসের জীবনযাত্রা ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। এখানে আরেকটি বাধা ছিল তাঁর হিজাব। এর কারণে অনেক ক্লায়েন্ট তাঁর সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করত। কখনও প্রকল্প ও বাজেট অনুমোদনের পরও তাঁকে বাদ দেওয়া হতো কেবল হিজাব পরার জন্য।
 
ফ্রিল্যান্স প্রকল্পে বহুবার তিনি পারিশ্রমিক পাননি। পরিবার অভিযোগ করতে বললেও তিনি উত্তর দিতেন, “এগুলো আমার জন্য শিক্ষা, ক্ষতি নয়।” মাইমুনা নার্গিসের আসল জাদু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তার প্রকল্পগুলিতে। মাইমুনা নার্গিসের আসল জাদু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তার প্রকল্পগুলিতে।জয়সলমিরের লুদরাওয়া জৈন মন্দিরের ৪০০ বছরের পুরনো কাঠের রথ ঘুণপোকার কারণে ভেঙে গিয়েছিল। মাইমুনা প্রথাগত উপকরণ ব্যবহার করে কোনও কারিগরের সাহায্য ছাড়াই সেটি মেরামত করেন, এখনও রথটি ব্যবহৃত হয়।
 
আজমেরের আকবর দুর্গে ৬ষ্ঠ থেকে ১৩শ শতাব্দীর ভাঙা মূর্তিগুলো এমনভাবে জোড়া লাগালেন যে ফাটল আর চোখে পড়ে না। কোটার জাদুঘরে সোনা ও কালিতে লেখা ৪০০ বছরের সংস্কৃত পাণ্ডুলিপির খণ্ডাংশ একত্রিত করে তাকে নতুন জীবন দিলেন। ঝালাওরের গড় প্রাসাদের ১১ কক্ষের ছাদের রঙিন চিত্রকর্ম পুনর্গঠন তাঁর সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। একটিও টুকরো না সরিয়ে এবং ক্ষতি না করে, তিনি তিনটি ঘরের সিলিং সংরক্ষণ করেছিলেন।
 
সিলিং-এ কাজ করে থাকা অবস্থায় মাইমুনা নার্গিস
 
বোম্বে বিমানবন্দরে মারাঠা ইতিহাসভিত্তিক ৫,০০০ বর্গফুট ক্যানভাস থেকে ভাঁজ ও বুদবুদ সরিয়ে সেটিকে আগের মতো মসৃণ করে তোলেন। রাষ্ট্রপতি ভবনে ইন্টার্নশিপের সময় কাঠের দরজায় আঁকা ঐতিহাসিক চিত্র রক্ষা করেছেন। জাতীয় জাদুঘরে বাবুরনামা, আকবরনামা, শাহজাহাননামা, জাহাঙ্গীরনামার মতো ঐতিহাসিক গ্রন্থ পুনর্নির্মাণ করেছেন। আলবার্ট হলে ক্ষতিগ্রস্ত পিচওয়াই চিত্রকর্ম ও রাজা-মহারাজার পোশাকেও নতুন প্রাণ ফিরিয়েছেন।
 
ইতিহাসের পাশাপাশি, মাইমুনা নার্গিস পরিবেশের প্রতিও সংবেদনশীল। মাইমুনা বলেন, সিমেন্টের আয়ু মাত্র ৩০ বছর, অথচ চুন–সুরকি দিয়ে তৈরি ভারতীয় প্রথাগত প্লাস্টার হাজার বছর টিকে যায়। এটি পরিবেশবান্ধব, সস্তা ও টেকসই। এই ধারণা নিয়ে তিনি দেরাদুনে ৪০০ বছরের পুরনো হাভেলির নকশায় এক ভবন নির্মাণ করেছেন এবং গুরগাঁওয়ে আধুনিক ফার্মহাউসও গড়েছেন প্রাচীন উপাদান দিয়ে।
 
এখন পর্যন্ত তিনি তিনটি জাতীয় এবং ২৮টি রাজ্যস্তরের পুরস্কার পেয়েছেন। কুরুক্ষেত্র (হরিয়ানা), জম্মু বিশ্ববিদ্যালয় ও জম্মু এফআইসিসি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। তাঁর স্বপ্ন, মধ্যপ্রদেশে কাদামাটি ও প্রথাগত রীতিতে এক হেরিটেজ রিসোর্ট তৈরি করা এবং মথুরার ৫০০ বছরের পুরনো এক মন্দিরকে নতুন সাজে ফিরিয়ে আনা।
 
মাইমুনা নার্গিসের দেয়ালচিত্র পুনরুদ্ধার করার একটি দৃশ্য
 
আজও তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে দাঁড়িয়ে নিজে চুন মেশান, দেয়াল প্লাস্টার করেন। গর্ব করে বলেন, “আমি ভারতের একমাত্র শিয়া মুসলিম নারী শিল্প সংরক্ষক। এটাই আমার পরিচয়।”
 
উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ জেলার বাহজোই নামের ছোট্ট শহরে জন্ম মাইমুনার। সাধারণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই মেয়েটি সবসময় বড় স্বপ্ন বুকে লালন করেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের চাকরিজীবী। পরিবার সবসময় তাঁকে উৎসাহ দিয়েছে ও এগিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি জয়পুরে স্থায়ী হয়েছেন।
 
মাইমুনার গল্প আমাদের শেখায়, নারী যেই পটভূমি থেকেই আসুক না কেন, যদি তার মধ্যে থাকে আবেগ, সাহস ও মেধা, তবে সে-ই ইতিহাস তৈরি করতে পারে এবং সমাজকে নতুন দিশা দিতে পারে। মাইমুনা নারগিস কেবল একটি নাম নন, তিনি সংস্কৃতি, নিষ্ঠা ও নারীশক্তির প্রতীক।