ইমতিয়াজ আহমেদ , গুয়াহাটি ঃ
যেভাবে কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকরের বিখ্যাত প্রশিক্ষক প্রয়াত রমাকান্ত আচরেকার ক্রিকেট কিংবদন্তির পুত্র অর্জুনকেও প্রশিক্ষণ দেওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই অসমের আচরেকারখ্যাত নবাব আলীও অসমের প্রাক্তন অধিনায়ক পরাগ দাসের পাশাপাশি তাঁর পুত্র রিয়ান পরাগকেও গড়ে তোলার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। রিয়ান পরাগ হলেন অসম থেকে ভারতীয় দলে স্থান পাওয়া প্রথম ক্রিকেটার।
ক্রিকেট মহলে সবাই স্নেহভরে নবাবদা বলে ডাকেন নবাব আলীকে।তিনি হয়তো তাঁর সংক্ষিপ্ত ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বেশি শতক বা অর্ধশতক অর্জন করতে পারেননি, কিন্তু অসমের পাশাপাশি দেশের ক্রিকেট ক্ষেত্রেও তিনি যে গুণগত ক্রিকেটার উপহার দিয়েছেন, সেই সংখ্যার বিচারে তিনি নিশ্চিতভাবে শতকের চেয়ে বেশি সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন ।
ক্রিকেট প্রশিক্ষণের জন্য জীবন উৎসর্গ করা ‘ক্রিকেটের নবাব’খ্যাত নবাব আলী.১৯৮৫ সাল থেকে অসমের হয়ে খেলা প্রায় সব প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার তৈরি করেছেন।
নবাব আলি প্রশিক্ষণরত
৫০ জনেরও বেশি প্রথম শ্রেণির (রঞ্জি ট্রফি,দেওধর ট্রফি,দুলীপ ট্রফি ইত্যাদি) খেলোয়াড় এবং ১০০ জনেরও বেশি জাতীয় বয়সভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার খেলোয়াড় গড়ে তুলে নবাব আলী অবশেষে সেই দিন প্রকৃত সফলতার স্বাদ পান, যখন রিয়ান পরাগ ভারতীয় দলের নীল জার্সি পরে মাঠে নামেন ।
নবাব আলী শুধু পরাগ দাস এবং রিয়ান পরাগকে গড়ে তোলেননি, তিনি অসমের প্রাক্তন ক্রিকেটার সৈয়দ জাকারিয়া জুফরি, নিশান্ত বরদলৈ, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, গৌতম শর্মা, জাভেদ জামান প্রমুখ ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর এখন তাঁদের দ্বিতীয় প্রজন্মের পুত্রদেরও লালন-পালন করছেন।
সবসময় ফিট এবং শান্ত স্বভাবের ৬০ ঊর্ধ্ব নবাবদা এমন একজন ব্যক্তি, যিনি অসম থেকে জাতীয় দলে স্থান পাওয়া ক্রিকেটার জন্ম দেওয়ার অভিযানে নামার পর থেকে কখনও কোনো ধরনের অসুস্থতার সম্মুখীন হননি। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি গৌহাটির নেহরু স্টেডিয়ামে "গুয়াহাটি ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র" নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করছেন এবং কখনও একটি সেশনও মিস করেননি ।
ময়দানে নবাব দা
১৯৭৮ সালে তৎকালীন বিসিসিআই ইস্ট জোনের প্রশিক্ষক এডুল বি আইবারা (Edul B Aibara) থেকে শেখা অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৫ বছর বয়সে ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন আলী।
১৯৮১-৮২ এবং ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে তিনি সি কে নাইডু ট্রফি স্কুল ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় অসমের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
সংক্ষিপ্ত ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত নুরুদ্দিন ট্রফির সিনিয়র আন্তঃজেলা ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় গুয়াহাটি জেলা দলকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ।
শৈশব থেকেই ক্রীড়া সংগঠন এবং প্রশিক্ষণের প্রতি নবাবদার বিশেষ আগ্রহ ছিল।প্রাতাই তিনি ১৯৮৪ সালে অসমের রাজ্য ক্রীড়া পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত একটি শিবিরে ভারতীয় ক্রীড়া প্রাধিকরনের প্রশিক্ষক বীরেন্দ্র কুমার শর্মার অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন।
"শর্মা গুয়াহাটি থেকে বদলি হওয়ার পর, ১৯৮৫ সালের মধ্যে নেহরু স্টেডিয়ামের এক কোণে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুরু হয়েছিল, এবং প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ হওয়ার কারণে আমি কনিষ্ঠদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছিলাম।"
আওয়াজ দ্য ভয়েস-এর সাথে এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে আলী বলেন,১৯৯২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে গুয়াহাটি ক্রীড়া সংস্থাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি একজন দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও পরিচয় দিয়েছেন।
তার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরে তার সমসাময়িক প্রয়াত আব্দুল রোফ,রাতুল দাস, আশরাফুর রহিম (রাজু) প্রমুখের সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রূপ লাভ করে এবং এটি "গুয়াহাটি ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র" নামে পরিচিত হয় ।
বর্তমানে এটি বহু প্রতিভাবান ক্রিকেটারের অন্যতম গ্রুমিং গ্রাউন্ড।তার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শুরুর ২৫-৩০ জন প্রশিক্ষার্থীর মধ্যে ছিলেন অসমের প্রাক্তন অধিনায়ক রাজিন্দর সিং, জাহির আহমেদ এবং বর্তমান বিসিসিআই-এর সচিব দেবজিৎ শইকিয়া প্রমুখ।
কচি কাঁচাদের নিয়ে নবাব আলির প্রশিক্ষণ
আজ এই কেন্দ্রটি ৩৫০ জন পর্যন্ত প্রশিক্ষার্থীদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ প্রদান করছে।নবাবদা গড়ে তোলা কয়েকজন সেরা ক্রিকেটারের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ জাকারিয়া জুফরি, আবু নাসিম আহমেদ, পরাগ দাস, নিশান্ত বরদলৈ, খনীন শইকিয়া, রিয়ান পরাগ, মৃগেন তালুকুদার, পলাশ জ্যোতি দাস, সাদেক ইমরান চৌধুরী ইত্যাদি ।
জাকারিয়া ২০০২ সালে চ্যালেঞ্জার ট্রফিতে ইন্ডিয়া 'বি' দলের হয়ে খেলেছিলেন, এবং ১৯ বছর অনূর্ধ্ব বিশ্বকাপের খেলোয়াড় আবু টিম ইন্ডিয়ার জন্য নির্বাচিত হওয়ার ঠিক আগে বিসিসিআই কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হন (কারণ তিনি ‘বিদ্রোহী’ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগে অংশ নিয়েছিলেন)।
আবুর পরিবর্তে ভারতের ১৯ বছর অনূর্ধ্ব দলের তার সতীর্থ পেস বোলার ঈশান্ত শর্মাকে নির্বাচক কমিটি ভারতীয় সিনিয়র দলে অন্তর্ভুক্ত করে।"টিম ইন্ডিয়ার হয়ে জাকারিয়া, গৌতম দত্ত এবং হেমাঙ্গা বরুয়া অবহেলিত হওয়ার সময় আমি যথেষ্ট হতাশ হয়েছিলাম, এবং আবু নাসিম ভারতের হয়ে খেলতে না পারাটাও আমাদের সবার জন্য একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ছিল। সেই সময়ে তিনি যথেষ্ট দুর্ভাগ্যবান ছিলেন।" নবাব আলী বলেন ।
তবে নবাব আলী আশা প্রকাশ করেন, যে তাঁর এক পুরনো প্রশিক্ষার্থী দেবজিৎ শইকিয়া বিসিসিআই-এর সচিব পদ গ্রহণ করার পর ভবিষ্যতে অসমের কোনো প্রতিভাবান খেলোয়াড় ভারতীয় দলে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বের মতো দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হবে না।
ময়দানে প্রশিক্ষণ নবাবের
"আমাদের বহু প্রতিভাকে এর আগে উপেক্ষা করা হয়েছিল কারণ আমাদের রাজ্যের ক্রিকেট প্রশাসন বিসিসিআই পর্যায়ে খেলোয়াড়দের এগিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু, আজ আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে অসম ভবিষ্যতে কখনও এমন উপেক্ষার সম্মুখীন হবে না। দেবজিৎ শইকিয়া একজন দক্ষ প্রশাসক,যার বিসিসিআই এবং আইসিসির পদে অধিষ্ঠিত হওয়া অসমের ক্রিকেটের জন্য এক আশীর্বাদ। বিসিসিআইতে তার উপস্থিতি অসমকে অনেক সহায়তা করেছে। অদূর ভবিষ্যতে তিনি আইসিসির প্রধান হবেন বলে আমি আশা করি" নবাবদার প্রতিক্রিয়া।আবু, মৃগেন, পলাশ এবং খনীন ভারতের ১৯ বছর অনূর্ধ্ব দলের জার্সি পরিধান করার বিপরীতে সাদেক ২০০১ সালে ভারতের ১৭ বছর অনূর্ধ্ব দলের হয়ে খেলেছিলেন।
নেহরু স্টেডিয়ামে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনার প্রসঙ্গে আলী বলেন, "যেহেতু নেহরু স্টেডিয়ামে সবসময় বিভিন্ন খেলা চলতে থাকে, এবং এটি তখন মহানগরের একমাত্র ক্রীড়া পরিকাঠামো ছিল, তাই আমাদের অনেক কিছু সামঞ্জস্য করে চলতে হয়েছে। তবে আমরা সবসময় অসমের ক্রীড়া বোর্ড এবং অসম ক্রিকেট সংস্থাসহ সকলের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি, এবং আমরা চাই যে অন্যান্য খেলাধুলাও উন্নতি করুক।
উল্লেখযোগ্যভাবে, নবাব আলীর অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে শুধুমাত্র গুয়াহাটি থেকেই নয়, দূরবর্তী শিবসাগর, চরাইদেউ, নাজিরা, ডিব্রুগড়, শিলচর, ধুবুরি প্রভৃতি স্থান থেকেও প্রশিক্ষার্থীরা এসে তাঁর অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে ভিড় করেন ।