এই ভূমিই সাক্ষী, ক্ষুধা এখানে ততটাই বাস্তব যতটা তার অনুর্বর জমি। এক গবেষণা অনুসারে, সাঁওতালের প্রায় ৮২ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে, এবং তাদের অধিকাংশেরই নিজস্ব জমি নেই। এই কঠিন বাস্তবতার মাঝখানে পাকুড়ের মুজাফ্ফর হুসেন দাঁড়িয়ে আছেন, যিনি ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইকে জীবনের লক্ষ্য করে তুলেছেন।
একটি সম্মেলনে মুজাফ্ফর হুসেন
তাঁর এই লড়াই শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে ‘রাইট টু ফুড অ্যাক্ট’ পাশ হওয়ার অনেক আগেই। আজ আইনটি কাগজে রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে খাদ্য যেন প্রকৃত প্রয়োজনীয়দের কাছে পৌঁছায়, সেটাই মুজাফ্ফরের জীবনের লক্ষ্য। তাঁর উদ্যোগে প্রায় ৬০০–৭০০ পরিবার এখন রেশন কার্ড পেয়েছে এবং নিয়মিত খাদ্যশস্য পাচ্ছে। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে অসংখ্য অজানা সংগ্রামের গল্প।
তাঁর নিজের গ্রাম নারায়ণপুরে একবার এক ব্যক্তি ক্ষুধায় মারা যান। দুই দিন ধরে তাঁর পরিবারে ভাত ছিল না। সেই ঘটনার পরই মুজাফ্ফরের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি সংকল্প নেন, এই ‘অপমান’ নামক ক্ষুধার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করবেন। তিনি শুরু করেন ছোট পরিসরে, প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ক্ষুধাগ্রস্ত পরিবারগুলিকে মাসে ১০ কিলো করে চাল দেওয়ার দাবি তোলেন। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অনাহারে মৃত্যুকে স্বীকার না করলেও, বাধ্য হয় অতি দরিদ্রদের অগ্রাধিকার দিতে।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে মুজাফ্ফর হুসেন
২০১৩ সালে ‘রাইট টু ফুড অ্যাক্ট’ কার্যকর হলে মুজাফ্ফর ও তাঁর সহকর্মীরা মনে করেন যেন তাঁরা এক অস্ত্র পেয়েছেন। তাঁরা ঘরে ঘরে গিয়ে ফর্ম পূরণ করান, সাপ্লাই অফিসে যান, রেশন কার্ড জোগাড় করেন। ধীরে ধীরে মানুষ তাঁদের অধিকার বুঝতে শুরু করে, আর আজ দরিদ্ররাই নিজেরাই মুজাফ্ফরের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন।
তবে লড়াই শেষ হয়নি। মুজাফ্ফর স্বীকার করেন, এখনও রেশন কার্ড পাওয়া কঠিন, অনলাইন পোর্টাল প্রায়ই ক্র্যাশ করে, গ্রীন কার্ডে ভুলভ্রান্তি ঘটে। কিন্তু এক জিনিস বদলেছে, এখন পিডিএস ডিলাররা আর ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারে না। অভিযোগ এলেই মুজাফ্ফর ও তাঁর দল ব্যবস্থা নেন। তাঁদের তৎপরতায় সরকার এখন প্রতিটি পঞ্চায়েতে ১০০ কুইন্টাল চালের জরুরি মজুত রাখে।
শাহীন একাডেমিতে মুজাফ্ফর হুসেনকে সম্মানিত করার একটি মুহূর্তে
ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই শেষে মুজাফ্ফর খুললেন আরেকটি ফ্রন্ট, অভিবাসনের বিরুদ্ধে। দুই বছরের গবেষণায় তিনি দেখলেন, কাজের অভাবে এই অঞ্চলের শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে বাইরে চলে যায়।讽াস্যকর হলেও, সরকারী প্রকল্পগুলোতেও প্রায়ই পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের নিয়োগ করা হতো। মুজাফ্ফর ঠিকাদারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন যাতে স্থানীয় শ্রমিকদের আগে নিয়োগ করা হয়। এর প্রভাব পড়ে, অভিবাসন কমে, আর স্থানীয় শ্রমিকরা বাইরের তুলনায় বেশি মজুরি পেতে শুরু করে। তবে প্রতিরোধও ছিল প্রবল। ঠিকাদাররা পাল্টা মিথ্যা মামলা করে তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। মুজাফ্ফর বলেন, “দুর্নীতি রাতারাতি দূর করা যায় না। একে ধীরে ধীরে ভাঙতে হয়, নইলে লড়াইটাই শেষ হয়ে যাবে।”
বর্তমানে তিনি এমজিএনআরইজিএ (MGNREGA)-র সোশ্যাল অডিটর হিসেবে কাজ করছেন। পাকুড়, গোদ্দা বা সাহেবগঞ্জে কোনো অনিয়ম দেখা দিলেই তিনি তা প্রকাশ্যে আনেন, যাতে শ্রমিকরা তাঁদের প্রাপ্য মজুরি পান এবং সরকারি অর্থের অপচয় রোধ হয়। তিনি নিয়মিতভাবে তথ্যের অধিকার আইন (RTI) ব্যবহার করেন এবং স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার বিষয়েও কাজ করেন। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড মিল্লি ফোরামের জেলা সমন্বয়ক ও রাজ্য সহ-সম্পাদক।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে মুজাফ্ফর হুসেন
মুজাফ্ফর হুসেনকে শুধু একজন সমাজকর্মী নয়, ক্ষুধার বিরুদ্ধে এক যোদ্ধা হিসেবে চেনে মানুষ। পাকুড়ের গলিতে প্রায়ই শোনা যায়, “মুজাফ্ফর না থাকলে আমাদের সন্তানরা আজও ক্ষুধার্ত ঘুমোত।” আরবি ভাষায় শিক্ষিত মুজাফ্ফর উত্তরপ্রদেশের মউ শহরের জামিয়া মিফতাহুল উলূম থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর শিক্ষাকে কর্মজীবনের পথ নয়, সেবার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
তাঁর লড়াই এখনও শেষ হয়নি। তাঁর স্বপ্ন, এক সাঁওতাল, যেখানে প্রতিটি ঘরে খাদ্য ও কাজ থাকবে, কোনো শ্রমিককে অভিবাসনে বাধ্য হতে হবে না, আর কোনো শিশু খালি পেটে ঘুমোবে না। তিনি জানেন পথ দীর্ঘ, কিন্তু বিশ্বাস করেন, যতদিন লড়াই বেঁচে আছে, ক্ষুধাকে জয় করা সম্ভব। যখন সাঁওতালের ইতিহাস লেখা হবে, দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অভিবাসনের কাহিনি নিয়ে, তখন এক নাম আলো হয়ে উঠবে অন্ধকারের ভিতর থেকে: মুজাফ্ফর হুসেন, সেই মানুষ, যিনি ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রমাণ করেছেন যে পরিবর্তন সম্ভব।