ড. ফিরদৌস খান
সমাজের মূল স্রোতে এমন কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা প্রচারের আলো এড়িয়ে নিঃশব্দে মানুষের জন্য কাজ করে যান। ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ ও ধর্মকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য করে নেওয়াই তাঁদের পরিচয়। হরিয়ানার হিসারের হোশিয়ার খান তেমনই এক নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক, যাঁর জীবন কেবল পারিবারিক দায়িত্বে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজের সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত। শৈশবকাল থেকেই মানবসেবা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ তাঁর চিন্তা ও কর্মকে পরিচালিত করেছে, যা তাঁকে সমাজের একজন নির্ভরযোগ্য অভিভাবকের মর্যাদা দিয়েছে।
হোশিয়ার খান নিজের জীবন সম্পর্কে বলেন, “আমার জন্ম ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৮ সালে হরিয়ানার হিসার জেলার থুরানা গ্রামে। তখন এই অঞ্চলটি ছিল যুক্ত পাঞ্জাবের অংশ। আমার মা নিম্বো ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও ধর্মনিষ্ঠ নারী, আর আমার বাবা আবদুল ছিলেন সরল, সৎ ও ধর্মপরায়ণ মানুষ। তিনি সবসময় খেয়াল রাখতেন যেন তাঁর কারণে কারও কোনো কষ্ট বা অসুবিধা না হয়। আমার বাবা-মা শিক্ষিত না হলেও আমাকে এবং আমার ভাই-বোনদের ভালো শিক্ষা দিয়েছেন। আমাদের ধর্ম ইসলাম শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। প্রতিটি মুসলমানের জন্য শিক্ষা অর্জন করা ফরজ। সেই সময় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা ছিল বড় সাফল্য, এবং আমি তা অর্জন করতে পেরেছিলাম।”
১৯৭৮ সালে হোশিয়ার খানের সরকারি কর্মজীবন শুরু হয়, যখন তিনি সেচ দপ্তরে সুপারভাইজার পদে নিযুক্ত হন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সরকারি পরিষেবা দিয়েছেন এবং এই সময়ে বহু সামাজিক ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, “সরকারি চাকরিতে থাকাকালীন আমি মেকানিক্যাল ইউনিয়নের প্রধান, সম্পাদক ও চেয়ারম্যান ছিলাম। পাশাপাশি ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লঘু সচিবালয় আবাস কলোনির প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। আমি সবসময় কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থের জন্য কাজ করেছি। তাঁদের ডিউটি সঠিকভাবে নির্ধারণ, বেতন ও বকেয়া আদায়, এই সব বিষয়েই আমাকে আন্দোলন ও ধরনা দিতে হয়েছে। আমার অধিকাংশ সময়ই এই কাজগুলিতেই কেটেছে।”
শুধু পেশাগত ক্ষেত্রেই নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক কাজেও হোশিয়ার খান সবসময় সক্রিয়। ২০০৪ সাল থেকে তিনি মুসলিম কল্যাণ কমিটি (গ্রামীণ ও শহর)-র সভাপতি। সমাজের কল্যাণ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মুসলিম কল্যাণ কমিটির মূল উদ্দেশ্য হলো সম্প্রদায়ের সমস্যা ও দাবিগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এই সংগঠনের মাধ্যমে অনগ্রসর শ্রেণির অধিকার, সংরক্ষণ এবং অন্যান্য সামাজিক বিষয় নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রয়োজনে আন্দোলনও করা হয়।
হোসিয়ার খান কিছু ব্যক্তির সঙ্গে
হিসারে মুসলিম সম্প্রদায়ের সুবিধার জন্য ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে প্রকাশ্যে নামাজের ব্যবস্থাও এই কমিটি করে থাকে। শহরে পর্যাপ্ত মসজিদ না থাকায় ক্রান্তিমান পার্কে নামাজের আয়োজন করা হয় এবং এর সম্পূর্ণ ব্যয় কমিটি বহন করে। এছাড়াও কমিটি হিসারের বারো কোয়ার্টার এলাকার কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে। পশু যাতে ভিতরে ঢুকতে না পারে, সেজন্য কবরস্থানের চারদিকে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। সময়ে সময়ে ঘাস কাটা, বর্ষার পরে মাটি ভরাট এবং কবর পরিষ্কারের কাজ করা হয়। কবরস্থানে জন্মানো বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, যাতে কবর খনন সহজ হয় এবং জমির সঠিক ব্যবহার সম্ভব হয়।
কবরস্থানের একাংশে একটি মাদ্রাসাও পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে প্রায় চল্লিশজন শিশু দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করছে। এখানে শিশুদের আরবি ও উর্দু ভাষার শিক্ষা দেওয়া হয় এবং কিছু শিশুর থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। তাদের খাবার-দাবারের সম্পূর্ণ খরচ কমিটি বহন করে। মাদ্রাসার একটি কক্ষে ইমামও থাকেন এবং নিয়মিত নামাজ আদায় হয়। সম্প্রতি মাদ্রাসার জন্য দুটি নতুন কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে, যার খরচ প্রায় ছয় লক্ষ টাকা। কমিটির আয় স্থায়ী নয় বলে নির্মাণকাজের জন্য কিছু অর্থ ধার নিতে হয়েছে।
হোসিয়ার খান কিছু ব্যক্তির সঙ্গে
মাদ্রাসার পাশে একটি সবুজ বাগান তৈরি করা হয়েছে, যেখানে গোলাপ, বেলা, মেহেদি, ডালিম, পেয়ারা ও খেজুর গাছ লাগানো হয়েছে। শিশুরা এখানে খেলাধুলা করে এবং পড়াশোনাও করে। কবরস্থানের ফটকের কাছে নিম, সজনে ও জাম গাছ লাগানো হয়েছে। এই পরিবেশ শিশুদের জন্য ঘরের মতো আবহ তৈরি করে এবং তাদের শিক্ষার পাশাপাশি মানসিক বিকাশেও সহায়ক হয়।
হোশিয়ার খান ওয়াক্ফ জমি ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়েও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। হিসারে ওয়াক্ফ সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার হচ্ছিল না। তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম কল্যাণ কমিটির সহায়তায় ২০১৩ সালে আইনে সংশোধন আনতে সক্ষম হন, যার ফলে ওয়াক্ফ জমির লিজ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয় এবং দরপত্র ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই আইন কার্যকর হলে আনুমানিক বছরে চারশো কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়। এছাড়াও হিসার ও হরিয়ানার বিভিন্ন কবরস্থানে অবৈধ দখলদারি উচ্ছেদের জন্য কমিটি প্রশাসন ও সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
হোসিয়ার খান একটি ব্যক্তির সঙ্গে
হোশিয়ার খানের জীবন সমাজ ও ধর্মের প্রতি নিবেদন, নৈতিকতা এবং জনসেবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁর বিশ্বাস, একজন মানুষের জীবন শুধু নিজের পরিবার বা ব্যক্তিগত স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং সমাজ ও সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্যও কাজ করা উচিত। তাঁর জীবন আমাদের এই বার্তাই দেয় যে, সততা, ধৈর্য ও আন্তরিক নিষ্ঠা থাকলে যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি অতিক্রম করে সমাজের জন্য স্থায়ী অবদান রাখা সম্ভব।