ড. আনোয়ারউদ্দিন চৌধুরী: ব্যতিক্রমী ব্যক্তি, অসম সরকারের ঊর্ধ্বতনকর্তা থেকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষক হয়েছেন

Story by  Daulat Rahman | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 Months ago
ড. আনোয়ারউদ্দিন চৌধুরী
ড. আনোয়ারউদ্দিন চৌধুরী
দৌলত রহমান , গুয়াহাটি:

ড. আনোয়ারউদ্দিন চৌধুরী অসম সরকারের কমিশনার এবং সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ড. চৌধুরী শুধুমাত্র একজন সরকারি কর্মকর্তা নন। নিজের আরামদায়ক অফিসিয়াল কক্ষে বসে থাকার পরিবর্তে তিনি অসমের বন্যপ্রাণীর পরিবর্তন আনতে একটি ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছিলেন।
 
সরকারি দায়িত্ব সম্পন্ন করার পর এই অসম সরকারের ঊর্ধ্বতনকর্তা  বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে বন্যপ্রাণী এবং বিভিন্ন পাখির মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন এবং পাখির প্রজাতি সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায় অনুসন্ধান করতেন। এজন্য তিনি “The Birdman of Assam” উপাধি লাভ করেন ।

সংবাদ মাধ্যমকে এড়িয়ে চলা এবং প্রচার বিমুখ  থাকা ড. চৌধুরী হলেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যের পাখিদের উপর বই লেখা অসমের প্রথম ব্যক্তি। তার গবেষণায়  অঞ্চলটির বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সংরক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তিনি ৩০টিরও বেশি গ্রন্থ, ৫০টি প্রযুক্তিগত প্রতিবেদন, ৯০০-এরও বেশি প্রবন্ধ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্রের লেখকও তিনি ।
 
 
ড. আনোয়ারউদ্দিন চৌধুরীর ভালোলাগা অরণ্যে 
 
বর্তমানে ৬৭ বছর বয়সী চৌধুরী সাদা হাঁস বা দেওহাঁসের সংরক্ষণ এবং ২০০৩ সালে এটিকে অসমের রাজ্য পাখি হিসেবে ঘোষণা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একসময় আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) এই পাখিটিকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে গণ্য করেছিল। আজকের তারিখে রাজ্যে ১৩০০-এরও বেশি দেওহাঁস রয়েছে।
 
অবসরের পর ড. চৌধুরী স্বাভাবিকভাবে পরিবারের সাথে বিলাসবহুল জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেই জীবন এড়িয়ে চলেছেন এবং এর পরিবর্তে অবসরের পর প্রচুর সময় প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ে লেখার জন্য ব্যয় করছেন । তিনি অসম থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় উড়ে যাওয়া এবং পূর্ব সাইবেরিয়ায় প্রজনন স্থান থাকা আমুর ফ্যালকন নামক পরিযায়ী পাখির উপর একটি প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন। চৌধুরী আওয়াজ দ্য ভয়েসকে বলেন, "অবসর নেওয়ার পর প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য কাজ করতে এবং লেখার জন্য আমার কাছে যথেষ্ট সময় রয়েছে।
 
তিনি সম্প্রতি সফলভাবে 'আমুর ফ্যালকন' নামক একটি পরিযায়ী পাখির উপর একটি প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন, যা অসম থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে পূর্ব সাইবেরিয়ায় তাদের প্রজনন স্থানে যায়। চৌধুরী বলেন, "আমুর ফ্যালকন (Falco amurensis) একটি দীর্ঘ দূরত্বের পরিযায়ী পাখি। এটি পূর্ব সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং সংলগ্ন অঞ্চলের আমুর নদীর অববাহিকায় প্রজনন করে এবং শীতকালে আফ্রিকায় অভিবাসন করে।
 
 
বন নিয়ে নিরলস সাধনার জন্য সংবর্ধনা প্রদান
 
পরিযায়ী পাখিগুলি উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্য দিয়ে পার হয় এবং তারপর উপদ্বীপীয় ভারত ও আরব সাগরের উপর দিয়ে উড়ে যায়। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অসম এবং মেঘালয়ের কিছু নির্বাচিত স্থানে হাজার হাজার, এমনকি লক্ষাধিক বাজপাখি অবস্থান করে।
 
অনেক চোরাশিকারি তাদের অসমের কার্বি আংলং জেলা বা নাগাল্যান্ডে জালের সাহায্যে ও খালি হাতে ধরার পাশাপাশি বন্দুক, এয়ার গান বা স্লিংশট দিয়ে গুলি করে মারে ।

১৯৯৬ সালে হাবাঙে একটি সচেতনতা অভিযান চালানো হয়েছিল এবং এর পরে পাখি ধরা বা পাখি হত্যার সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করে। ২০০৪ সালে নাগাল্যান্ডের মোকোকচুং জেলায় চৌধুরীর একই ধরনের অভিযানের ফলে চোংটংয়াতে শিকার করা হ্রাস পেয়েছিল, সেখানে বৃহৎ সংখ্যক মানুষ বসবাস করত ।
 
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যপ্রাণী নিয়ে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য ড. চৌধুরীকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তার পাখিদের উপর বিস্তৃত চেকলিস্ট (১৯৯০) এবং অসমের পাখিদের উপর একটি বিশদ গ্রন্থ (২০০০) এ. হিউম এবং স্টুয়ার্ট বেকারের প্রথম চেকলিস্টের পরে স্থান পেয়েছে ।
 
ড. আনোয়ারউদ্দিন চৌধুরী দুর্গম অরন্য পথে 
 
তার অন্যান্য কিছু গ্রন্থ হল অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং মেঘালয়ের পাখিদের উপর বই, এবং বন্য জল মহিষের প্রথম মনোগ্রাফ (২০১০), উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তৃত স্তন্যপায়ী (২০১৩), ভারতের স্তন্যপায়ী (২০১৬) এবং মানস: বিপদের মধ্যে ভারতের বিশ্ব ঐতিহ্য ক্ষেত্র (২০১৯)।
 
১৯৯৬ সালে ড. চৌধুরী নাগাল্যান্ডের কোহিমার একটি বাজার পরিদর্শন করার সময় টাউন হলের ঠিক বাইরে বিক্রির জন্য অস্বাভাবিক সামগ্রীর সারি দেখতে পান। ক্রেতাদের জন্য প্রদত্ত খাদ্যের মধ্যে ছিল ব্যাঙ, সাপ, হরিণ, পাখি, একটি বাঁশের পার্ট্রিজ, একটি চীনা প্যাঙ্গোলিন, একটি শূকরের লেজযুক্ত মেকাক (pig-tail macaque) ইত্যাদি। মহিলারা তাদের শিকারী স্বামীরা বাড়িতে নিয়ে আসা প্রাণীগুলি বিক্রি করছিল ।এই দৃশ্য দেখে বিচলিত হয়ে ড. চৌধুরী একটি বেসরকারি সংস্থা পিপলস গ্রুপ অফ নাগাল্যান্ডের সাথে যোগাযোগ করেন এবং প্রজনন মৌসুমে বন্যপ্রাণী বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানান ।
 
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তৃত ভ্রমণ ড. চৌধুরীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষকে সহায় সহযোগিতা করার সুযোগ দিয়েছে। ৩০ বছর আগে তিনি ৫০ বছর বয়সী কার্বি জনজাতির সারসিং রংফারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যিনি বন্য প্রাণী হত্যা করে জীবিকার জন্য মাংস বিক্রি করতেন। চৌধুরী রংফারকে শিকার ছাড়তে রাজি করিয়ে বন বিভাগে একটি চাকরি দিয়েছিলেন।
পূর্ব আসামের বাকসা জেলার সহকারী-কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় ড. চৌধুরী মানস জাতীয় উদ্যানে  চোরাশিকারিতে  লিপ্তদের অস্ত্র-শস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি করিয়েছিলেন, যার অনুসরণ পরবর্তী সময়ে অন্যান্য স্থানেও দেখা গেছে। ড. চৌধুরীর বন্যপ্রাণীর প্রতি আকর্ষণ এবং ভালোবাসা অসম সরকারকে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে একটি এনজিওতে যোগ দিতে অনুমতি দিতে বাধ্য করেছিল।

“অসমের ক্ষেত্রে এটি একটি নিয়মভঙ্গকারী সিদ্ধান্ত ছিল। প্রথমবারের মতো সরকারের থেকে এনজিওতে ডেপুটেশনের ব্যবস্থা শুরু করা হয়েছিল। এজন্য আমি তখনকার অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত হিতেশ্বর শইকীয়া এবং আধিকারিক থেকে মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা হওয়া প্রয়াত যতীন হাজরিকার প্রতি এখনও কৃতজ্ঞ।”  তিনি বলেন ।

অসম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য অনেক অনাবিষ্কৃত পরিবেশ ও স্থান উন্মোচনের আশাই তাকে আজও এগিয়ে নিয়ে যায়। ড. চৌধুরী স্বাভাবিক শক্তি ও উদ্যমের সঙ্গে বলেন, যে ভবিষ্যতে তিনি ভুটান, পূর্ব নেপাল, দক্ষিণ তিব্বত, উত্তর ও পশ্চিম মিয়ানমার এবং পূর্ব বাংলাদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন।