দৌলত রহমান, গুয়াহাটি
বাবা তাকে সাইকেল উপহার দেওয়ার পরই আর্শেল আখতার জীবনে নিজে সাইকেল চালাতে শেখেন। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। ছুটির দিনে তিনি বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে পাশের এলাকা ঘুরে দেখতেন। ২০০১ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের আগ পর্যন্ত অনিয়মিত হলেও তিনি সাইকেল চালিয়ে ঘোরা অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু চাকরিতে যোগদানের পর আর্শেল আখতার সাইকেল চালানো বন্ধ করে দেন এবং বাবার থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া সাইকেলটি বিক্রি করে শেষ পর্যন্ত একটি গাড়ি কিনেন। কিন্তু কর্পোরেট চাকরি এবং নতুন গাড়িটির সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা খুব রোমাঞ্চকর বা স্মরণীয় হয়নি। তাই পরবর্তী সময়ে কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা শুরু করেন এবং ২০১৬ সালে পুনরায় সাইক্লিংয়ের পুরানো নেশায় মেতে উঠেন।
এভাবেই আজ আর্শেল আখতার শুধু সাইকেল চালকদের মধ্যেই নয়, বরং অসমের সাধারণ মানুষের মধ্যেও সবচেয়ে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। তিনি এখন রাজ্যজুড়ে সাইকেল চালিয়ে সমাজে ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সদাব্যস্ত গুয়াহাটি মহানগরে সাইকেল চালানকে একটি নির্ভরযোগ্য যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে জনমত গড়ছেন।
২০১৬ সাল থেকে আর্শেল সাইকেলে গুয়াহাটি ও তার আশেপাশের এলাকাগুলো অন্বেষণ শুরু করেন এবং ক্রমান্বয়ে উইকেন্ড রাইডের সময় মিলেমিশে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। তিনি বিভিন্ন সাইক্লিং হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগ দিয়ে আরও বেশি সাইক্লিং অনুরাগীদের সঙ্গে যুক্ত হন।
২০১৭ সালের মাঝামাঝি আর্শেল বুঝতে পারেন যে তিনি সাইক্লিংয়ের জগতে আরও বেশি কিছু করতে পারেন। এই উদ্দেশ্যে প্রথম পর্যায়ে তিনি ছুটির দিনে সাইকেল রাইড, বিশেষ অনুষ্ঠানে সাইকেল র্যালি এবং পরে আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সাইকেল অভিযান, আলোচনা ও কনক্লেভের আয়োজন করেন।
আর্শেল সবুজের সাথী সাইকেল নিয়ে
২০১৮ সালে আর্শেল ‘সাইকেল মেয়র’ নামক এক কর্মসূচির কথা জানতে পারেন এবং এই কর্মসূচির অংশ হতে তিনি সাইকেল চালানোর প্রতি তার আকর্ষণ এবং গুয়াহাটি মহানগরের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে তিন পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনসহ আবেদন করেন। আমস্টারডামে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক এনজিও BYCS তার তিনটি অনলাইন সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এবং আর্শেলকে সাইকেল মেয়র পদে উপযুক্ত মনে করেন।
এনজিওটি তাকে সক্রিয় স্থানীয় নাগরিকদের থেকে সাতটি অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে বলেছিল। তিনি ৪০ জনেরও বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এবং প্রায় ২০টি অনুমতি পত্র পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ধরিত্রী দিবস উপলক্ষে আর্শেলকে গুয়াহাটির প্রথম সাইকেল মেয়র হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
“এই নতুন নিযুক্তি আমাকে শুধু সমগ্র আসামের স্থানীয় প্রশাসন এবং সাইকেল চালানোর সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হতে দেয়নি, বরং এটা বুঝতে সাহায্য করেছে যে বেশিরভাগ মানুষ সাইকেল চালনাকে শুধুমাত্র ক্রীড়া বা বিনোদনের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন কিন্তু যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে নয়। এই উপলব্ধি আমাকে বহনক্ষম পরিবহন, সাইকেল চালনার সরকারি পরিকল্পনা এবং নীতিগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট ধারণাগুলো অনুসন্ধান করতে বাধ্য করেছে। আমি জানতে চেয়েছিলাম এসব কেন ব্যর্থ হয়েছে বা কার্যকর হয়নি।” আর্শেল এক একান্ত সাক্ষাৎকারে আওয়াজ-দ্য ভয়েসকে জানান।
সাইকেল যাত্রায় অংশ নিয়েছেন আর্শেল
ধীরে ধীরে আর্শেলের দিনগুলো ভালো হতে শুরু করে। ২০১৯ সালে দুই-তিনজন বন্ধুর সঙ্গে আর্শেল সাইকেল চালনার সব দিকেই গুরুত্ব দিয়ে ‘পেডেল ফর এ চেঞ্জ’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাইক্লিংকে মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্য তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
“২০১৯ সাল থেকে আমি সাইকেল চালনাকে একটি জরুরি মহানগরের গতিশীলতার বিকল্প হিসেবে দেখা শুরু করেছিলাম, যা দুটি বড় মহানগরের চ্যালেঞ্জ প্ৰদূষণ এবং যানজট মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে। অন্য শহরের সহকর্মী সাইকেল মেয়র, মহানগরে পরিবহন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মূলত লিঙ্কডিনের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন, প্রবন্ধ ও বই পড়া, এবং অনলাইন বিষয়বস্তুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমি আমার শিক্ষাগত প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়েছি। ২০২০ সালের মধ্যে আমি বহনক্ষম শহুরে গতিশীলতা (Sustainable Urban Mobility) সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেছিলাম, এবং আমার প্রচেষ্টাগুলো ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হতে শুরু করেছিল।” আর্শেল বলেন।
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সাইকেল চালকদের সাথে অধিক সংযোগ স্থাপনের জন্য আর্শেলে ২০২৩ সালের জুন–জুলাই মাসে সমগ্র অসমে একক সাইকেল চালানোর যাত্রা শুরু করেছিলেন। এই যাত্রায় তিনি ২৮ দিনের মধ্যে ২৭টি জেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ২০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন। ভ্রমণের মাধ্যমে সাইক্লিস্টটি জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য সচেতনতা, সক্রিয় গতিশীলতা এবং পথ নিরাপত্তার বার্তাও প্রচার করেছিলেন।
আর্শেল ও অনান্যরা
গুয়াহাটিতে পেডেল ফর এ চেঞ্জের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে (যারা ২০২০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তাদের সাথে যোগদান করেছিল) হওয়া আদান-প্রদান থেকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হয়ে আর্শেল ২০২৪ সালে পুরভকা ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফাউন্ডেশনটি এখন জলবায়ু সুরক্ষা, গণপরিবহন, সক্রিয় গতিশীলতা (হাঁটা এবং সাইকেল চালানো), এবং পথ নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত কাজ করছে।
"আমি এখন সাইকেল রাইডের আয়োজন করি এবং বিভিন্ন সংস্থার জন্য সাইকেল র্যালি পরিচালনা করি। একইভাবে স্পোকহাব সাইক্লিং (Spokehub Cycling) এর সাথে অংশীদারিত্বে সাইকেল রেস আয়োজন করি। এটি ESAF Foundation এর সহযোগিতায় আমরা ওপেন স্ট্রিট গুয়াহাতিতেও আয়োজন করছি। আমরা প্রতি মাসে কয়েক দিন গাড়ি ব্যবহার না করার জন্য উৎসাহিত করি ‘I Am Car-Free Today’ এর মতো অভিযান চালাচ্ছি, এবং সাইকেল চালকদের ও পথচারীদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ‘We Too’ নামের একটি অভিযান শুরু করেছি।” আর্শেল বলেন।
আর্শেল এবং তার সংগঠন মহানগরের গতিশীলতার সমস্যাগুলোর সহযোগিতামূলক সমাধান খুঁজতে অনলাইন আলোচনা সেশন (পেডেল টকস), অফলাইন সংলাপ (মোবিলিটি টকস), এবং অংশগ্রহণমূলক নিয়োজিত সেশন (লেট’স গেট ইনভলভড) পরিচালনা করছেন। গণপরিবহন এবং সাইকেল চালানোর প্রতি মানুষের মনোভাব বুঝতে তারা জরিপ এবং গবেষণাও করেছে। ২০২৩ সালে তারা সাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনকে স্বীকৃতি দিতে উত্তর-পূর্ব সাইক্লিং পুরস্কার শুরু করেছে।
"আমরা গুয়াহাটি’র কয়েকটি বিদ্যালয়ে সাইকেল র্যালির আয়োজন করেছি, যদিও অনেক ছাত্র-ছাত্রী মূলত অন্য সংগঠনের পরিচালিত বড় র্যালিতে অংশগ্রহণ করে। বিশেষ করে স্পোকহাব সাইক্লিং-এর সাথে অংশীদারিত্বে আয়োজিত সাইকেল দৌড় ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী তরুণ অংশগ্রহণকারীদের আকর্ষণ করে" আর্শেল আখতারের মতামত।
সামাজিক পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আর্শেল আখতার
পুরভকা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আর্শেল বহনক্ষম শহুরে গতিশীলতার জন্য প্রমাণ এবং সমর্থন গড়ে তুলতে আরও গবেষণা চালানোর পরিকল্পনা করছেন। আর্শেল এবং তার দল হাঁটা ও সাইকেল চালানোর মাধ্যমে পাড়ার পর্যায়ে সুলভতা (neighborhood-level accessibility) উন্নত করার জন্য একটি পাইলট প্রকল্পের কাজ করছে। বিশেষ করে স্থানীয় এলাকাগুলিকে প্রধান গণপরিবহন ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করা। পরে এই পাইলট প্রকল্পগুলো গুয়াহাটির অন্যান্য এলাকায় এবং সর্বশেষে অসমের অন্যান্য শহরেও সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
"আমি জীবিকা নির্বাহের জন্য সাইকেল চালকদের সাহায্যের জন্য একটি বিশেষ কর্মসূচী শুরু করার পরিকল্পনা করছি। যারা আর্থিক প্রয়োজনের কারণে সাইকেল চালায়। এর পাশাপাশি আমরা স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের কেন্দ্র করে সাইকেল চালানোর উদ্যোগের ওপর কাজ করছি। এবার আমরা সেই ব্যক্তিদের সাইক্লিং ক্ষেত্রে প্রদান করা অবদানের জন্য উৎসাহিত করতে উত্তর-পূর্ব সাইক্লিং পুরস্কারের দ্বিতীয় সংস্করণও আয়োজন করব" আর্শেল জানান।