অসমের এক ব্যতিক্রমী মৌলানা

Story by  Daulat Rahman | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 Months ago
মৌলানা নুরুল আমিন কাসেমী
মৌলানা নুরুল আমিন কাসেমী
দৌলত রহমান , গুয়াহাটি ঃ

উত্তর প্রদেশের ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ও চেমিনারি দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া অসমের অধিকাংশ মুসলিম যুবককে পরবর্তীকালে মসজিদ, মাদ্রাসা ইত্যাদির মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে পবিত্র কোরআন ও অন্যান্য ইসলামিক আচার-আচরণ নতুন প্রজন্মকে শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। কিন্তু, সেই একই দারুল উলুমের প্রাক্তন ছাত্র মৌলানা নুরুল আমিন কাসেমী সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ইসলামিক শিক্ষা গ্রহণ করার পর মৌলানা কাসেমী নিজেকে সমাজকল্যাণমূলক কর্মযজ্ঞে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে প্রচলিত বহু ভুল ধারণা দূর করার জন্য তিনি একটি অভিনব অভিযান শুরু করেন। তিনি সারা অসম জুড়ে ব্যতিক্রমী ও উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে সঠিকভাবে ইসলাম প্রচার করে আসছেন।

ইতিমধ্যেই মৌলানা কাসেমীর বহু ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এই ভিডিওগুলিতে মৌলানা কাসেমী শিক্ষার গুরুত্ব এবং ইসলাম ধর্মের মূল দর্শন সাধারণ মানুষের বোঝার উপযোগী সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন। তিনি পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত স্থানীয় অসমীয়া ভাষায় অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে তুলেছেন।
 

দরিদ্র মহিলাদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ
 
মসজিদ, ঈদগাহ, মাদ্রাসা, জনসভা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে মৌলানা কাসেমী তাঁর প্রেরণাদায়ক বক্তব্যের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। মৌলানা কাসেমী সম্প্রতি পবিত্র কোরআনের অসমীয়া ব্যাখ্যা ও অনুবাদ অসমীয়া পাঠকদের জন্য প্রকাশ করেছেন। আজকাল অনেকেই সময়ের অভাবে বই পড়তে পারেন না। সেই কারণে মৌলানা কাসেমী ভয়েস ওভার-এর মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের অসমীয়া অনুবাদ অডিও আকারে প্রকাশ করেছেন।মৌলানা কাসেমী প্রগতিশীল চিন্তাধারায় ইসলামিক শিক্ষা গ্রহণকারী কয়েকজন যুবকের সঙ্গে মিলিত হয়ে মধ্য আসামের তেজপুর শহরে ইসলামিক রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন।

মৌলানা কাসেমী মধ্য আসামের শোণিতপুর জেলার চতিয়া অঞ্চল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর ইসলামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে লখিমপুর জেলার খুতকতিয়া দিন আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে ৬ বছর পড়াশোনা করার পর তিনি হোজাই জেলার জলালিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন।

মৌলানা কাসেমী হোজাইয়ের জলালিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নের সময়েই হাইস্কুল শিক্ষান্ত পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ইসলামিক শিক্ষার পাঠ সম্পন্ন করেন। দেওবন্দ মাদ্রাসায় ইসলামিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর মৌলানা কাসেমী মধ্য আসামের হোজাই জেলার মার্কাজুল মা-আরিফে শিক্ষকতা শুরু করেন।
 
 
মৌলানা নুরুল আমিন কাসেমী স্টুডিয়োতে
 
শিক্ষকতা করার সময়েই মৌলানা কাসেমী সাধারণ শিক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক বা দ্বাদশ শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। এর পর তিনি রূপহী মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পিএইচ.ডি.র জন্য অধ্যয়ন করছেন। 
 
আওয়াজ দ্য ভয়েস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মৌলানা কাসেমী বলেন,"আমরা অসমীয়া মুসলমান, এবং আমরা অসমীয়া মুসলমান হিসেবেই বেঁচে আছি। ইসলাম নিয়ে কখনও কখনও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, এবং কিছু মুসলমান ব্যক্তির কারণেই অনেকের মধ্যে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি হয়। ইসলাম ধর্মের কিছু অনুসারী জ্ঞানের অভাবে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে আসছে। আমি মনে করেছি, পবিত্র কোরআন ও হজরত মোহাম্মদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সঠিক জ্ঞান দেওয়া দরকার।
 
আমাদের ইসলামকে তার প্রকৃত রূপে এবং আমাদের স্থানীয় ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে। এই কারণেই আমি এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় লিপিবদ্ধ, সুতরাং এই পবিত্র গ্রন্থগুলিকে সবার কাছে আমাদের স্থানীয় ভাষায় বোঝানো আমাদের দায়িত্ব।"
 
  
কৃতী ছাত্রীকে  সংবর্ধনা প্রদান
 
মৌলানা কাসেমী আরও বলেন,বাধ্যতামূলক জুম্মার নামাজ (শুক্রবারের নামাজ) উপলক্ষে যখন মুসলিমরা একত্রিত হয়, তখন ইমাম ‘খুতবা’ নামক ধর্মোপদেশ প্রদান করেন। এই ‘খুতবা’-য় ইমাম ইসলামিক নীতি, সমাজের প্রতি ব্যক্তির দায়িত্ব, সৎ কাজের প্রতি আহ্বান এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি সম্মান ইত্যাদি বিষয় স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন।
কিন্তু যেহেতু অনেক মসজিদে এই ‘খুতবা’ আরবি ভাষায় দেওয়া হয়,তাই আয়াতগুলোর প্রকৃত অর্থ বুঝে ওঠা স্থানীয় মানুষের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। 
 
 "আমি ভেবেছিলাম শান্তি, মানবতার বার্তা বা ‘খুতবা’-য় দেওয়া বক্তব্য যদি মানুষ সহজ ও স্থানীয় ভাষায় বুঝতে পারে, তাহলে তারা যথেষ্ট উপকৃত হতে পারবে এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে থাকা ভুল ধারণাগুলো দূর হবে। আরবি ভাষায় ‘খুতবা’ পাঠের ক্ষেত্রে মতাদর্শগত পার্থক্য দেখা যায়। কেউ কেউ বলেন, এটা মাতৃভাষায় বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের ইসলামিক বিধি অনুযায়ী নবীর যুগ থেকে আরবি ভাষায় ‘খুতবা’ পাঠের ঐতিহ্য চলে আসছে, তাই কিছু কিছু স্থানে এর পরিবর্তন হয়নি,"—মৌলানা কাসেমী বলেন।
 
মৌলানা কাসেমী বলেন, ইসলামিক শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম সমাজ শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। মুসলিম সমাজে মৌলানা বা উলামাদের সম্মানিত ব্যক্তি এবং ধর্মগুরু হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই উলামারা যদি শিক্ষার ক্ষেত্রে পরামর্শ দেন, তাহলে আমি মনে করি সবাই তাদের অনুসরণ করে উপকৃত হতে পারবে। এই ক্ষেত্রে আমাদের ধর্মগুরুদের অনেক কাজ বাকি আছে। ধর্মীয় মণ্ডলীতে এই বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব কম দেওয়া হয়। ইসলামিক মৌলিক শিক্ষা নেওয়া বাধ্যতামূলক, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য ভালো নাগরিক এবং ব্যক্তি হতে হলে সাধারণ শিক্ষিত হওয়াও প্রয়োজনীয়।
 
মৌলানা নুরুল আমিন কাসেমীড় সমাজ সেবা
 
মৌলানা কাসেমী যেসব ধর্মীয় সভাতে আমন্ত্রণ পান, সেখানে ধারাবাহিকভাবে একই ধরনের বক্তৃতা দিচ্ছেন। তিনি বলেন,"আমাদের হজরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের শিক্ষার জন্য এমন আদেশ দিয়েছেন যে চীন দেশেও যেতে হবে। পবিত্র কোরআনের প্রথম শব্দই হলো ‘ইকরা’ (পড়ো)। যদিও আমাদের নবী আমাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য চীনেও যেতে বলেছিলেন, কিন্তু চীনে ইসলামিক শিক্ষার কোনো বিস্তৃতি নেই। তাই আমাদের নবী একই সময়ে ইসলামিক শিক্ষার পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি ও আধুনিক শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে মাত্র ৪% মুসলিম শিশু মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন।" 
 
 
 মৌলানা কাসেমী আরো বলেন,"সব মুসলিম ছেলে-মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে হবে না, এবং সবাই করাও প্রয়োজন নেই। মাত্র ৪% মৌলানা বা হাফেজ হতে হবে, কারণ ভবিষ্যতে তাদেরই ধর্ম রক্ষা করতে হবে। বাকি ৯৬% ছাত্র-ছাত্রীদের আধুনিক শিক্ষা নিয়ে নিজেদের শিক্ষিত করে সমাজের ভাল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে।"
 
মাদ্রাসায় পড়া বা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণকারী শিশুদের পাশাপাশি স্কুল ত্যাগকারী শিক্ষার্থীদের কথাও আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন বলে মৌলানা কাসেমী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, শিক্ষার মাধ্যমেই মুসলিম সম্প্রদায়কে বর্তমান অবস্থার থেকে উদ্ধার করা সম্ভবপর হবে।