ফারহান ইসরায়েলি/জয়পুর
আব্দুল সালাম জোহর নামে এক ব্যক্তি ঐতিহ্যের সঙ্গে উদ্ভাবনের সংমিশ্রণে রাজস্থানের মণিহার সম্প্রদায়কে সম্মানের নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি কেবল হাতে তৈরি চুড়ি নন, তিনি আশা,পরিবর্তন এবং আলোর এক অনন্য উদাহরণ।
তাঁর এই যাত্রা আমাদের শিখিয়েছেন আবেগ, কঠোর পরিশ্রম এবং সামাজিক চেতনার সংমিশ্রণ যে কোনও পরিবর্তনের ভিত্তি হতে পারে। জয়পুরের পিংক প্রাচীর এবং রঙিন রাজপথে ছড়িয়ে থাকা সুগন্ধ কেবল সুগন্ধিই নয়, এতে এই শহরের পরিচিত ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের আত্মাও রয়েছে। এই গলিতে লক্ষ লক্ষ টাকার চুড়ি তৈরি করা হয়, যা ঐতিহ্যগত সৌন্দর্যের প্রতীক এবং হাজার হাজার হাতের পরিশ্রমের ফল।
আব্দুল সালাম জোহরের পুরস্কার গ্রহন করার একটি দৃশ্য
এই পৃথিবী থেকেই এমন একটি নাম জন্ম নিয়েছে যা শিল্পকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে এবং সামাজিক সংস্কারের দিকে গভীর ছাপ ফেলেছে। মনিহার সম্প্রদায়ের আব্দুল সালাম জোহর, এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবে তাঁর স্বপ্নগুলি অসাধারণ ছিল। তাঁর পিতামহ হাফিজ মহম্মদ ইসমাইল ছিলেন এই সম্প্রদায়ের প্রথম হাফিজ, যিনি পরিবারে ব্যবসা ও ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর পিতা হাজী আবদুল আজিজ এবং মা হাজ্জান কামার জাহানের সংগ্রাম দেখে জোহর কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং সমাজসেবাকে তাঁর জীবনের প্রধান মন্ত্র করে তুলেছিলেন।
জয়পুরের ত্রিপলিয়া বাজারে অবস্থিত তাঁর পৈতৃক দোকান 'ইন্ডিয়ান কঙ্গন অ্যান্ড কালার স্টোর' থেকে শুরু করে এই যাত্রা এখন বিশ্ব বাজারে 'জোহর ডিজাইন', 'জোহর কিং' এবং 'ইন্ডিয়ান ক্রাফ্টস'-এর মতো ব্র্যান্ডে পৌঁছেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, দুবাই এবং অন্যান্য আরব দেশে তার গ্রাহক রয়েছে। হাতে তৈরি সুতার উচ্চ চাহিদা এবং সীমিত উৎপাদনের কারণে অনেক সময় গ্রাহকদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এটি লক্ষণীয় যে তিনি তাঁর খনিগুলিকে কেবল বাণিজ্যিকভাবে কার্যকরই করেননি, বরং সেগুলিকে উদ্ভাবন ও সমাজকল্যাণের মাধ্যমও গড়ে করে তুলেছিলেন।
আবদুল সালাম জোহর খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি খারু উৎপাদনের সাথে খুব বেশি দূরে যেতে পারবেন না এবং তাই তিনি আঁকা ব্রাশ, পিতলের জিনিসপত্র, কাঠের পণ্য, নীল মৃৎশিল্প এবং হস্তনির্মিত কাগজ সহ অনেক হস্তশিল্প অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই পদক্ষেপটি বাজারে একটি নতুন প্রাণবন্ততা তৈরি করে এবং তাঁর সমৃদ্ধ পণ্যগুলি পোশাক এবং ফ্যাশনের জগতে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। বড়দিনের আলোকসজ্জার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রিসমাস বল, সান্তা ক্লজ, জুয়েল বক্স, মোমবাতি স্ট্যান্ড, ফটো ফ্রেম, কলম স্ট্যান্ড, ফুলের পাত্র, কাঠের প্রাণীর মতো জিনিসের প্রচুর চাহিদা ছিল।
আবদুল সলাম জোহরের দোকান
জোহর বুঝতে পেরেছিলেন যে এই সাফল্য কেবল তখনই স্থায়ী হবে যদি এর পিছনে থাকা কারিগরদের সম্মান, সুরক্ষা এবং ন্যায্য বেতন দেওয়া হয়। যদিও গরম লোহা দিয়ে কাজ করার সময় প্রায় কারিগরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে অকালে মারা যেতেন, আব্দুল সালাম জোহর তাদের সুরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ, অনুপ্রাণিত এবং উচ্চ মজুরি দিয়েছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে, এই ঐতিহ্য সিকার, ঝুনঝুনু, ফতেহপুর এবং শেখাওয়াতি গ্রামের হাজার হাজার পরিবারের জীবিকার উৎস হয়ে ওঠে।
২০০০ সালের মধ্যে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে। কিন্তু তারপরে বিশ্ব বাজার চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডের সস্তা এবং দীর্ঘস্থায়ী পণ্যগুলিতে প্লাবিত হয়েছিল। এই বিদেশী পণ্যগুলি দেখতে ছোট হলেও এগুলিতে ঐতিহ্যের চেতনা এবং ভারতীয় কারিগরদের কঠোর পরিশ্রমের অভাব ছিল।
তা সত্ত্বেও, ভারতীয় বাজার এই কৃত্রিম, রাসায়নিক-ভিত্তিক বিকল্পের দিকে ঝুঁকেছিল। ফলস্বরূপ, জোহরের মতো উদ্যোক্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জগুলো কঠিন হয়ে ওঠে। ক্রমবর্ধমান কাঁচামালের খরচ এবং কঠোর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা তাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। আরও খারাপ, শিল্প বা এর শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য খুব কম বা কোনও সরকারী সহায়তা ছিল না।
লেক, কয়লা, কাঁচ, চকচকে পাউডারের মতো কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকল, কিন্তু কোনও সরকারি প্রকল্প কারিগরদের সাহায্য করেনি। ফলস্বরূপ, অনেক কারিগর এই পেশা ছেড়ে ছোট দোকান শুরু করে বা মজুরি শ্রমিক হয়ে ওঠে। এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আব্দুল সালাম জোহর সমাজসেবার সংকল্পকে কখনও দুর্বল হতে দেননি। স্কুল ও কলেজের দিন থেকেই তিনি মণিহার সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন।
আব্দুল সালাম জোহরের পুরস্কার গ্রহন করার একটি দৃশ্য
একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি দশ থেকে বারো বছর ধরে মৃত্যুভোজ, অপ্রয়োজনীয় যৌতুক এবং অন্যান্য আড়ম্বরপূর্ণ রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছিলেন। তিনি মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেছিলেন যে এই সামাজিক ব্যাধিগুলি থেকে মুক্তি পাওয়াটাই আসল অগ্রগতি। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে এমন অনেক ঐতিহ্য পরিবর্তন হয়েছে, সমাজের চিন্তাভাবনা বদলেছে, নতুন প্রজন্ম নতুন দিশা পেয়েছে। তিনি ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে একটি সম্প্রদায়ের অগ্রগতি কেবল দেশের অর্থনীতিকে বাড়িয়ে তুলবে না, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি অনেক উপকারে আসবে।
আবদুল সালাম জোহরের কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্ভাবন দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ভারত গৌরব পুরস্কার, ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, আন্তর্জাতিক কোহিনূর পুরস্কার, সমাজ রত্ন, গান্ধী শান্তি পুরস্কার এবং অন্যান্য অনেক মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এই পুরস্কারটি ভারত, নেপাল এবং ব্যাংককে প্রদান করা হয়, যা তাঁর বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির প্রমাণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তিনি আফসোস করেছিলেন যে আব্দুল সালাম জোহর রাজস্থান সরকারের কাছ থেকে কোনও সমর্থন পাননি। তিনি লেকের মতো একটি অনন্য ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।
বার্ণিশের কাজ সম্পূর্ণরূপে হাতে তৈরি এবং এতে মেশিনের কোনও ভূমিকা নেই। তাই তাঁর মতে, সরকারের উচিত কম সুদে সস্তা ঋণ প্রদান, কাঁচামাল ছাড়, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কারিগরদের বাজারের সুযোগ-সুবিধার মতো পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যান্য কারিগরদের সঙ্গে তিনি স্থায়ী সমাধান হিসাবে একটি নিবেদিত হস্তশিল্প বোর্ড স্থাপনের বিষয়টিকে স্বাগত জানাবেন, যেখানে কারিগরদের এক জায়গায় জায়গা, সম্পদ এবং বাজার রয়েছে। অবিলম্বে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে, এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা ধীরে ধীরে মারা যাবে এবং হাজার হাজার পরিবারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।

আব্দুল সালাম জোহারির হাতের জাদু মাখা শিল্প
জোহরের মতে বার্ণিশের শিল্প কেবল একটি ব্যবসা নয়, রাজস্থানের সাংস্কৃতিক আত্মা। শুধু সরকার নয়, সমগ্র সমাজকে এটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। আবদুল সালাম জোহরের জন্য, এই কাজটি কেবল লাভের মাধ্যম নয়, শিল্প ও ঐতিহ্যের প্রতি সেবা ও সম্মান দেখানোর একটি মাধ্যমও। তিনি তাঁর জীবনের এই যাত্রাকে ব্যক্তিগত যাত্রা হিসাবে বিবেচনা করেন না, বরং সম্মিলিত সংগ্রাম ও উন্নতির গল্প হিসাবে বিবেচনা করেন। তাঁর স্বপ্ন হল, আগামী প্রজন্ম এই শিল্পকে গর্বের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বিশ্ব আদালতে তা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করবে।
বার্ণিশ হল একটি আঠালো পদার্থ যা গাছগুলিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র পোকামাকড় দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয়। লোকেরা এই আঠালো পদার্থটি সংগ্রহ করে গরম করে এবং এটিকে রঙিন লাঠি বা মোড়কে রূপান্তরিত করে। এখান থেকে কারিগররা সুন্দর চুড়ি, আলংকারিক জিনিসপত্র, আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরি করে। একে বার্ণিশের কাজ বা বার্ণিশের সংস্কৃতি বলা হয়। এই ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প ভারতের রাজস্থান, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অনুশীলন করা হয়ে আসছে। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং পরিবেশ বান্ধব।