ড. ফিরদৌস খান
কখনও কখনও একজন মানুষের একটি পরামর্শ শুধু কারও জীবনই বদলে দেয় না, বরং পুরো সমাজকে একটি নতুন পথ দেখায়। হরিয়ানার গুরগাঁওয়ের আসলাম খানের জীবনেও এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল। রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি পরিচিত মুখ না হলেও, সমাজসেবার ক্ষেত্রে তিনি সকলের কাছে একজন আদর্শ মানুষ হয়ে উঠেছেন। আসলাম খানের জীবন প্রমাণ করে যে, সমাজের জন্য আন্তরিকভাবে করা প্রচেষ্টাই মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী প্রভাব ফেলে।
আসলাম খান নিজের যাত্রার কথা স্মরণ করে বলেন, “প্রায় আড়াই দশক আগে আমি গুরগাঁওয়ের একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের অফিসে আমার রাজনৈতিক দলের প্রেস নোট নিয়ে যেতাম। বেশিরভাগ সময়ই সেগুলো প্রকাশিত হতো না। এতে আমার মনে হতো, হয়তো আমার কাজই মূল্যহীন। তবুও আমি নিয়মিত প্রেস নোট নিয়ে যেতাম। একদিন অফিসে কর্মরত একজন সাংবাদিক আমাকে বলেন, এখানে আপনাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। আমি কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনার সঙ্গে কোনও শক্তিশালী জনসমর্থন নেই। পাশাপাশি তিনি আমাকে পরামর্শ দেন যে, যদি সত্যিই সমাজে পরিচিতি গড়তে চাই, তবে একটি ট্রাস্ট গঠন করে সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা উচিত। তিনি আরও বলেন, যারা অন্যের কল্যাণে কাজ করে, মানুষ তাদেরই গুরুত্ব দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেই এবং ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করি, যেখানে দুর্গম অঞ্চল থেকেও বহু মানুষ আসেন। তাঁদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়। মানুষের সমাগম দেখে আমার উৎসাহ আরও বেড়ে যায় এবং আমি বিশ্বাস করি যে, আমি সঠিক পথেই এগোচ্ছি।”
এই অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনার পর আসলাম খান ‘হরিয়ানা অঞ্জুমন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। ট্রাস্টের সভাপতি আসলাম খান বলেন, “আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি ডিসপেনসারি দিয়ে। এর পেছনের কারণ হলো, ২০০০ সালে আমার মা ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাদের বহু হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। সেই সময় আমি দেখেছি অনেক মানুষ আছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য অর্থ নেই। তাঁদের কষ্ট দেখে আমার মনে হয়েছিল, আর্তজনের জন্য কিছু করা উচিত। এই ভাবনা থেকেই গুরগাঁওয়ে ট্রাস্টের মাধ্যমে দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসার পরিকল্পনা করি। আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরাও সবসময় পাশে থেকে এই কাজে সহযোগিতা করেছেন। ধীরে ধীরে আরও অনেক মানুষ যুক্ত হন এবং এভাবেই ২০০৩ সালে হরিয়ানা অঞ্জুমন চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নিবন্ধন হয়। এই ট্রাস্টের মূল উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র ও অনাথদের সেবা করা।”
এই ট্রাস্ট গুরগাঁওয়ের সেক্টর ২৮-এর চকরপুর গ্রামে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য একটি ডিসপেনসারি চালু করেছে। আসলাম খান বলেন, “আমরা অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি, যাঁরা বিনামূল্যে সেবা দিতে রাজি হন। এখানে রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে এই ডিসপেনসারির সুনাম দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা চাওয়া হলে তাঁরা খোলামনে আর্থিক সাহায্য দেন। পরে একটি অ্যাম্বুলেন্সও কেনা হয়, যা গুরুতর রোগী পরিবহণের পাশাপাশি মৃতদেহ বহনেও ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ট্রাস্ট নিয়মিত বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবিরের আয়োজন করে, যেখানে ডায়াবেটিস পরীক্ষা সহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়।”
আসলাম খানের এনজিও পরিচালিত একটি স্কুল
শীতকালে ট্রাস্ট দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে গরম কাপড়, কম্বল ও চাদর বিতরণ করে। আসলাম খান জানান, এই সব কাজ মানুষের অনুদানের কারণেই সম্ভব হয়। মানুষের সহযোগিতাতেই এই সেবামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যাচ্ছে।
এই ট্রাস্ট গুরগাঁওয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি নতুন কবরস্থানও নির্মাণ করেছে। আসলাম খান বলেন, “নতুন গুরগাঁওয়ে মুসলিমদের দাফনের কোনও সুব্যবস্থা ছিল না। বহু দূরে নিয়ে গিয়ে মৃতদেহ দাফন করতে হতো, যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। আমরা হুডার কাছে আবেদন করি এবং সেক্টর ৫৬/৫৮-এ কবরস্থানের জন্য জমি বরাদ্দ পাই। সেখানে বিদ্যুৎ, জল ও সীমানা প্রাচীরসহ সব রকমের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। ট্রাস্ট মৃতদেহ দাফনের সমস্ত কাজও করে থাকে। সুন্নতি পদ্ধতিতে গোসল, কাফন ও দাফন করা হয়। দুর্ঘটনায় বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গও এখানে দাফন করা হয়।”
তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প
নামাজের সুবিধার দিকেও ট্রাস্ট নজর দিয়েছে। গুরগাঁওয়ের সেক্টর ৫৭-এ জমি অধিগ্রহণ করে ‘অঞ্জুমন জামা মসজিদ’ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে নিয়মিত নামাজ হয় এবং শুক্রবার জুম্মার নামাজে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি উপস্থিত হন। রমজান মাসে ইফতারের বিশেষ ব্যবস্থাও করা হয়। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ট্রাস্টের। বিদ্যুতের সমস্যার সমাধানে ২৫ কেভিএ সাইলেন্ট জেনারেটরও স্থাপন করা হয়েছে।
অঞ্জুমন জামা মসজিদ ট্রাস্ট দরিদ্র ও গৃহহীন শিশুদের জন্য বিনামূল্যে সাক্ষরতা কেন্দ্রও চালু করেছে। আসলাম খানের মতে, এখানে শিশুদের উর্দু, আরবি, হিন্দি, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান শেখানো হয়। শিশুদের সার্বিক ব্যক্তিত্ব বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং তাদের শৃঙ্খলা ও নৈতিক মূল্যবোধ শেখানো হয়। স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ত্যাগ স্মরণ করা হয়। শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা পরীক্ষা শিবিরও আয়োজন করা হয়। ঈদ উপলক্ষে শিশুদের নতুন জামাকাপড় ও জুতো দেওয়া হয়, যাতে তারা আনন্দের সঙ্গে উৎসব পালন করতে পারে।
পিছিয়ে পড়া শিশুদের সাথে আসলাম খান
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আসলাম খান বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো গুরুতর রোগীদের জন্য সমস্ত আধুনিক সুবিধাসহ একটি বড় হাসপাতাল স্থাপন করা। পাশাপাশি একটি বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই, যেখানে শিশুরা আধুনিক ও সার্বজনিক শিক্ষা লাভ করতে পারবে এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারবে।” তাঁর এই সমাজসেবামূলক কাজে তাঁর পুত্র ডাঃ আরিফ খানও সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন।
হরিয়ানা অঞ্জুমন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট তাদের সমস্ত কার্যক্রমের জন্য সাধারণ মানুষের আর্থিক সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। যাঁরা এই মহতী কাজে সহযোগিতা করতে চান, তাঁরা ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয়ের নম্বর ৯৩৫০১৮৪১১৯-এ যোগাযোগ করতে পারেন। আসলাম খান ও তাঁর ট্রাস্ট প্রমাণ করেছেন যে, সততা, ধৈর্য ও সৎ উদ্দেশ্য থাকলে সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনা সম্ভব।