সুদীপ শর্মা চৌধূরী / গুয়াহাটি
ভারতের ক্রীড়া ও বিনোদন জগতে এমন কয়েকজন তারকা যারা শুধু দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বমঞ্চে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন, তাদের গল্প আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা।
জাকির খানের হাসির ঝড় থেকে শুভমান গিলের অসাধারণ ব্যাটিং, রিচা ঘোষের মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৫-এর নায়িকা ভূমিকা, মোহাম্মদ আশরাফ আলীর উদীয়মান অ্যাথলেটিক্স তারকা এবং মোহাম্মদ শামি আহমেদের দ্রুতগতির বলের জাদু, এরা সকলে ভারতের যুবশক্তির প্রতীক। তাদের শৈশব, সংগ্রাম, সাফল্য, চ্যালেঞ্জ দেশকে গর্বিত করেছে। এরা কেবল তারকা নন, জাতীয় গৌরবের প্রতীক।
জাকির খান
ভারতীয় কমেডিকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যাওয়া হাস্যরসের রাজা জাকির খান, নামটাই যেন হাসির ঝড় তুলে দেয়।উত্তরপ্রদেশের ইন্দোরে ১৯৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করা এই কমেডিয়ান ভারতীয় হাস্যরসকে গ্লোবাল স্টেজে পৌঁছে দিয়েছেন। তার স্ট্যান্ড-আপ কমেডি শো সাকত্ত লাভ জাকির থেকে শুরু করে নেটফ্লিক্সের হাসসে আধা এবং তালা ওয়ালা – জাকিরের গল্পগুলো সাধারণ ভারতীয়ের জীবনকে ছুঁয়ে যায়। ২০২৫ সালে তার নতুন ট্যুর জাকির খান লাইভ ইন ইউরোপ বিশ্বব্যাপী সৌলসাউট করে। শৈশব এবং শুরুর দিনগুলো: ইন্দোরের রাস্তায় হাসির জন্মজাকিরের শৈশবে তার বাবা একজন মিস্ত্রি ছিলেন এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল ছিল না। ছোটবেলায় উর্দু কবিতা, লোককথা এবং পরিবারের গল্প শুনতে শুনতে তার মধ্যে গল্প বলার প্রতিভা জাগ্রত হয়। স্কুলে তিনি ক্লাসের 'ক্লাউন' ছিলেন, কিন্তু কলেজে ওপেন মাইক ইভেন্টে অংশ নিয়ে প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। ২০১২ সালে ফানকার্স শোতে অংশগ্রহণ করে তিনি জাতীয় পরিচিতি পান।
মুম্বাই পৌঁছে তিনি কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হন – ছোট গিগ, রিহার্সাল, অসংখ্য প্রত্যাখ্যান এবং রাতের ট্রেনে ঘুরে বেড়ানো। এক সাক্ষাৎকারে জাকির বলেন, "ইন্দোরের চায়ের দোকান থেকে মুম্বাইয়ের স্টেজ – এটা ছিল হাসির জন্য লড়াই। "গ্লোবাল ব্রেকথ্রু এবং সাম্প্রতিক সাফল্য২০১৯ সালে সাকত্ত লাভ জাকির নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়ে ১ কোটিরও বেশি ভিউ পায়। এরপর কোত্তেদা সান্নাতা সো নাই (২০২১) এবং হাসসে আধা (২০২৩) তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। ২০২৫ সালে লন্ডনের ওয়েম্বলি এরিনায় তার শো ৫০,০০০ দর্শক আকর্ষণ করে। আজ তিনি ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং দুবাইয়ে পারফর্ম করছেন।
জাতীয়ভাবে, জাকির ভারতীয় কমেডিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার শোতে নারী-পুরুষ সম্পর্ক, পরিবারের ঝগড়া, প্রেমের গল্প এবং মানসিক স্বাস্থ্য – সবকিছু এমনভাবে উপস্থাপিত যা প্রত্যেক ভারতীয়ের সাথে যুক্ত। চ্যালেঞ্জ এবং সামাজিক প্রভাব কোভিড-১৯-এর সময় তার শো বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু অনলাইন লাইভ করে তিনি যুবকদের মেন্টাল হেলথ নিয়ে কথা বলেন। তার ফাউন্ডেশন 'জাকির হাস ফাউন্ডেশন' মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কাজ করে। পুরস্কারের তালিকা:ইমিজ অ্যাওয়ার্ডস ২০২০ – বেস্ট স্ট্যান্ড-আপ।ফ্যান চয়েস অ্যাওয়ার্ড ২০২৩। নেটফ্লিক্স প্লেয়লিস্ট অ্যাওয়ার্ড। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: ২০২৬-এ হলিউড স্টাইল ওয়েব সিরিজ এবং ভারতীয় কমেডি ফিল্ম। ১ কোটিরও বেশি ইউটিউব সাবস্ক্রাইবার, যুবকদের মধ্যে কমেডি ক্যারিয়ারের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়েছে।জাকিরের সাফল্য প্রমাণ করে যে ভারতীয় সংস্কৃতির হাস্যরস বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য। জাতীয় গৌরবের এই প্রতীক আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, হাসিতে বিপ্লব ঘটানো যায়।
শুভমান গিল
এলিগ্যান্ট ব্যাটার যিনি ক্রিকেটের নতুন যুগ শুরু করলেন শুভমান গিল, ভারতের ক্রিকেটের নতুন রাজকুমার। পাঞ্জাবের ফজিলকা থেকে উঠে আসা এই খেলোয়াড় তার এলিগ্যান্ট ব্যাটিং স্টাইলে বিশ্বকাপ, আইপিএল এবং টেস্টে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। সামঞ্জস্যপূর্ণ ড্রাইভ, নিখুঁত টাইমিং এবং শান্ত মনোভাব – গিলের ব্যাট থেকে বেরোনো শটগুলো কবিতার মতো। ২০২৫ সালে তার টেস্ট শতরা সিরিজ ভারতকে নম্বর ১ করে তোলে।
ফজিলকার মাঠ থেকে আন্তর্জাতিক স্টেজ ২০০০ সালে জন্মগ্রহণ করা শুভমানের শৈশবে তার বাবা লক্ষ্মণ সিং গিল একজন বিজনেসম্যান ছিলেন, কিন্তু পরিবার ক্রিকেটের জন্য সবকিছু ত্যাগ করে। ৮ বছর বয়সে ফজিলকার স্থানীয় ক্লাবে যোগ দেন। পাঞ্জাব স্টেট টিমে ডেবিউ করে ২০১৮ সালে ইউ-১৯ বিশ্বকাপে ভারতকে চ্যাম্পিয়ন করেন (৪০৬ রান)। আইপিএল-এ কেএক্সআর তাকে ১.৮ কোটি টাকায় কিনে নেয়।
এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "ফজিলকার ধুলোমাখা মাঠ আমাকে শিখিয়েছে ধৈর্য। "সাম্প্রতিক অর্জন এবং ক্যাপ্টেন্সি ২০২৩ আইপিএল-এ অরেঞ্জ ক্যাপ (৯২৮ রান), ২০২৪ টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল শতরা। ২০২৫ সালে ওডিআই বিশ্বকাপে ৮০০+ রান করে প্লেয়ার অফ টুর্নামেন্ট। আজ তিনি টি-২০ এবং ওডিআই ক্যাপ্টেন। তার নেতৃত্বে ভারত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জয় করে। চ্যালেঞ্জ এবং জাতীয় ভূমিকাফর্ম স্লাম্প এবং আঘাতের মুখোমুখি হয়েও ফিরে আসেন। পাঞ্জাবের যুবকদের অনুপ্রাণিত করে ক্রিকেট অ্যাকাডেমি খোলেন।উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান: টেস্ট: ৩৫০০+ রান, ১০ শতরা। ওডিআই: ৪০০০+ রান, গড় ৫৫।আইপিএল: ৩০০০+ রান। পুরস্কার: অর্জুন অ্যাওয়ার্ড ২০২৪, পদ্মশ্রী প্রার্থী। ভবিষ্যৎ: ২০২৭ বিশ্বকাপের মূল খেলোয়াড়।শুভমানের গল্প ভারতের যুবশক্তির প্রতীক – ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম এবং মহানত্ব।
রিচা ঘোষ
মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৫-এর জাতীয় নায়িকা রিচা ঘোষ, ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের উজ্জ্বল তারকা।পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গ থেকে উঠে আসা এই উইকেটকিপার-ব্যাটার ২০২৫ সালের মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপে তার অসাধারণ পারফরমেন্সে ভারতকে চ্যাম্পিয়ন করে জাতীয় নায়িকা হয়ে ওঠেন। তার দ্রুতগতির ব্যাটিং (স্ট্রাইক রেট ১৩৫+) এবং নিখুঁত কিপিং ভারতকে চূড়ান্তে নিয়ে যায়।
২০০৩ সালে জন্মগ্রহণ করা রিচা। ১০ বছর বয়সে ছেলেদের সাথে রাস্তায় ক্রিকেট খেলেন। ১৪ বছরে ডোমেস্টিক ডেবিউ, ২০২০ সালে আইপিএল-এ বেঙ্গলুরু সুপার গিয়ান্টস। বিশ্বকাপ ২০২৫ ফাইনালে অপরাজেয় ৮৯ রান করে ভারতকে শিরোপা এনে দেন। বলেন, "উত্তরবঙ্গের মেয়েরা স্বপ্ন দেখতে পারে। "সাম্প্রতিক সাফল্য এবং সামাজিক প্রভাব বিশ্বকাপে ৫৬০ রান, ২৫ স্টাম্পিং। তার সাফল্য মহিলা ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। গ্রামে অ্যাকাডেমি খোলেন। পরিসংখ্যান: বিশ্বকাপ ২০২৫: সর্বোচ্চ রানস্কোরার (৫৬০ রান)। ৫০ ওভারে ৪ শতরা। টি-২০আই: ১৫০০+ রান। মহিলা অর্জুন অ্যাওয়ার্ড ২০২৫। ভবিষ্যৎ: অলরাউন্ডার হিসেবে ২০৩০ কমনওয়েলথ গেমস। রিচার গল্প ভারতের নারীশক্তির জয়গান।
মোহাম্মদ আশরাফ আলী
উদীয়মান অ্যাথলেটিক্স তারকা, যুব স্বীকৃতির প্রতীক মোহাম্মদ আশরাফ আলী – ভারতের অ্যাথলেটিক্সে নতুন নাম। বাংলার উদীয়মান এই ২০ বছরের যুবক তার ১০০মিটার দৌড় (১০.২৫ সেকেন্ড) এবং লং জাম্পে জাতীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০২৫ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতে অলিম্পিক সম্ভাব্য।
গ্রাম থেকে জাতীয় মঞ্চশৈশবে গরিব পরিবারে বেড়ে উঠে স্কুল স্পোর্টসে শুরু। ন্যাশনাল ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে ৩ সোনা। ২০২৫-এ এশিয়ান গেমসে রূপান্তর ইভেন্টে মেডেল। ন্যাশনাল ইয়ুথ রেকর্ড (১০০মিটার)। এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ সোনা ২০২৫। অলিম্পিক কোয়ালিফায়ার ২০২৮। দেশের যুবকদের অনুপ্রাণিত। ২০২৮ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক মেডেল। আশরাফ ভারতের অ্যাথলেটিক্সের ভবিষ্যৎ।
মোহাম্মদ শামি আহমেদ
দ্রুতগতির বলের জাদুকর মোহাম্মদ শামি আহমেদ, ভারতের প্রখ্যাত ফাস্ট বোলার। উত্তরপ্রদেশের আমরোহা থেকে এই ৩৫ বছরের তারকা তার ১৪৫+ কেএমএইচ স্পিড এবং সুইংয়ে বিশ্ব জয় করেছেন। ২০২৩ বিশ্বকাপে ২৪ উইকেট। ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতা এবং চ্যালেঞ্জ ২০১৩ ডেবিউ। টেস্টে ২৩০+ উইকেট। আঘাত থেকে ২০২৫-এ ফিরে আসেন। আইপিএল-এ গুজরাতের তারকা। রেকর্ড: বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট (৫৮+)। টেস্টে ৭ ফাইফার।২০০+ আন্তর্জাতিক উইকেট। পুরস্কার: আর্জুন, পদ্মশ্রী। কোচিং এবং মেন্টরশিপ।শামির বল ভারতের আগ্রাসী ক্রিকেটের প্রতীক।
ভারতের বৈচিত্র্যময় প্রতিভার প্রমাণ। জাকিরের হাসি, গিলের এলিগ্যান্স, রিচার শক্তি, আশরাফের গতি এবং শামির আগুন – সবাই জাতীয় গৌরব বাড়াচ্ছে। ভারত বিশ্বের শীর্ষে উঠছে।