আরিফুল ইসলাম / গুয়াহাটি
প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ময়মনসিংহ জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর সংঘটিত নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় বিশ্ববাসীর বিবেক আজ স্তব্ধ। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড মানবসভ্যতার মুখে এক গভীর কলঙ্কচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। বাংলাদেশের এক কারখানার শ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে অসমের মুসলিম সমাজ গভীরভাবে মর্মাহত। ‘আওয়াজ-দ্য ভয়েস’-এর সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা এই ঘটনাকে “মানবতা, সভ্য সমাজ, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর সরাসরি আঘাত” বলে অভিহিত করেছেন।
অসম রাজ্য জমিয়ত উলেমার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক মৌলানা ফজলুল করিম কাসমি বলেন, “বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা চরম দুর্ভাগ্যজনক। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। ইতিমধ্যেই অসম রাজ্য জমিয়ত উলেমার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের হাইকমিশনের দপ্তরে একটি স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সে বিষয়ে প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং যে কোনো মূল্যে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের ঘটনাই বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখার পরিবেশ তৈরি করে। তাই আমরা শুধু নিন্দাই জানাইনি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদও সংগঠিত করেছি।”
বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটি দৃশ্য, কর্মী দীপু চন্দ্র দাস
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির উত্থান স্পষ্ট। বর্তমান সরকার সেই শক্তিকে পরোক্ষভাবে পুষ্ট করছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে এমন উত্থান দেখা যায়নি। নোবেলজয়ী ড. মহম্মদ ইউনুস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ভারতের প্রতি শত্রুতামূলক মনোভাব নিয়ে দেশ পরিচালনা শুরু হলে বাংলাদেশ নিজেই বিপদের মুখে পড়বে। এতে দেশটি শিক্ষা ও অর্থনীতিতে পাকিস্তানের মতো দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। আমরা কখনোই মৌলবাদকে সমর্থন করতে পারি না। বিশ্বের যেসব দেশে সরকার মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছে, সেসব দেশ ধ্বংসের পথে গেছে, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক তার উদাহরণ। আমরা এই শক্তিকে ঘৃণা করি এবং ভারতের সরকারের পাশে আছি। ভারত সরকার যদি কোনো পদক্ষেপ নেয়, আমরা সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গেই থাকব।”
বাংলাদেশের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলে সদৌ অসম গরিয়া-মরিয়া জাতীয় পরিষদের নেতা নুরুল হক বলেন, “বাংলাদেশে যা ঘটছে তা শুধু অমানবিকই নয়, গোটা ইসলাম ধর্মাবলম্বী সমাজকে লজ্জিত করছে। ইসলাম মানবতা, শান্তি ও ভালোবাসার ধর্ম, কিন্তু কিছু মৌলবাদী সেই মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে। অসমের মুসলমানরাও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। মানুষ কতটা নৃশংস হলে আরেক মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে পারে! ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে এবং বিশেষ করে অসমে সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ যেন শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে, সে বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের দেশ ও রাজ্যে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের সরকারিভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। একই সঙ্গে আমাদের নিজেদেরও সজাগ থাকতে হবে, যাতে এ ধরনের চিন্তা শুধু ইসলাম নয়, কোনো ধর্মের মধ্যেই শিকড় গাড়তে না পারে। বাংলাদেশের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আমি ভারতের বিদেশ মন্ত্রককে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানাই।”
মহম্মদ ইউনুস
এদিকে সদৌ বড়োল্যান্ড সংখ্যালঘু ছাত্র সংস্থার সদস্যরা এই বর্বর ঘটনার বিরুদ্ধে তামুলপুর জেলায় এক বৃহৎ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। এবিএমএসইউর সভাপতি টাইসন হুসেন বলেন, “বাংলাদেশে সংঘটিত অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদে আমরা রাজপথে নেমেছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মহম্মদ ইউনুসের কুশপুত্তলিকাও দাহ করেছি। আমরা অবিলম্বে বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাই। পাশাপাশি, সেখানে কিছু ধর্মীয় মৌলবাদীর ভারতবিরোধী মন্তব্যও লক্ষ্য করছি। তারা ভুলে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। বাংলাদেশ থেকে কেউ ভারতবিরোধী কথা বললে, অসম ও ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা তা কখনোই মেনে নেবে না।”
ইসলামি চিন্তাবিদ মৌলানা নুরুল আমিন কাছিমি বলেন, “বাংলাদেশে এক হিন্দু নাগরিকের ওপর সংঘটিত বর্বরতার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। সুস্থ মানসিকতার কোনো মানুষ এমন কাজ করতে পারে না। সব বিবেকবান মানুষের উচিত এর প্রতিবাদ করা।”
উল্লেখযোগ্য যে, সম্প্রতি সদৌ অসম গরিয়া-মরিয়া-দেশী জাতীয় পরিষদের দরং জেলা কমিটির উদ্যোগে মঙ্গলদৈ শহরের করিম চক-এ শতাধিক নেতা-কর্মী ও স্থানীয় মানুষের উপস্থিতিতে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংস পরিস্থিতিতে মৌলবাদী জেহাদিদের হাতে সংখ্যালঘু যুবক দীপু চন্দ্র দাসকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় এবং বাংলাদেশের অমুসলিম সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তোলা হয়।
প্রতীকী ছবি
প্রতিবাদকারীরা “বাংলাদেশ নিপাত যাক”, “মৌলবাদী জেহাদি হুঁশিয়ার”, “দীপু দাস হত্যার বিচার চাই”, “এই অন্যায় সহ্য করা হবে না”, “অমুসলিম সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দাও”, “ইউনুস সরকার হায় হায়”, “ইউনুসের নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নাও”, “ভারত বাংলাদেশকে উপযুক্ত জবাব দিক”, এই সব স্লোগানে এলাকা প্রকম্পিত করে তোলেন।
এই কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠনের কেন্দ্রীয় মুখ্য উপদেষ্টা ড. চহির ভূঁইয়া দীপু দাসের নৃশংস হত্যার তীব্র নিন্দা জানান। তিনি দাবি করেন, তথাকথিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মহম্মদ ইউনুসের সরকারই এই ঘটনার সম্পূর্ণ দায়ী। আন্তর্জাতিক নোবেল কমিটির কাছে তিনি আং সান সু চির মতো ইউনুসের নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবি জানান। একই সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ অসমকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেওয়া জেহাদি-মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
প্রতিবাদকারীরা নিহত জেহাদি নেতা ওসমান হাদিকে ‘শহিদ’ ঘোষণা করার বিরুদ্ধেও তীব্র আপত্তি জানান এবং প্রশ্ন তোলেন, সাহস থাকলে নিরীহ দীপু দাসকেই শহিদ ঘোষণা করা হোক। ইউনুস সরকারের অপসারণের দাবিতে তাঁর প্রতিকৃতি দাহ করা হয় এবং শহিদ দীপু চন্দ্র দাসের ছবিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।