শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
কলকাতার বড়দিন মানে শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এ শহরের ইতিহাসে তা বহুদিন ধরেই ছিল মিলন, সহাবস্থান ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির প্রতীক। আশ্চর্যের কথা, কলকাতায় বড়দিনের যাত্রা শুরু হয়েছিল শহরের জন্মলগ্নেই, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে।
ইতিহাস বলে, ১৬৬৮ সালে প্রাণ বাঁচাতে হুগলি ছেড়ে পালাতে গিয়ে জোব চার্ণক আশ্রয় নিয়েছিলেন গঙ্গার ধারে বনজঙ্গলে ঢাকা ছোট্ট গ্রাম সুতানুটিতে। মোগল সেনাদের চোখ এড়িয়ে সেখানে টানা দু’মাস লুকিয়ে থাকার সময়ই আসে বড়দিন। নির্জন সেই গ্রামে, একেবারে অচেনা পরিবেশে চার্ণক বড়দিন পালন করেন, আর সেখান থেকেই কলকাতার প্রথম বড়দিনের ইতিহাস শুরু। তখন ধর্মীয় উৎসব ছিল ব্যক্তিগত প্রার্থনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই উৎসবই হয়ে উঠল নগরজীবনের অংশ।
বড়দিন উপলক্ষে সজ্জিত কলকাতা রাস্তাঘাটের একটি ছবি
১৬৯০ সালে চার্ণক পাকাপাকিভাবে সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা নিয়ে কলকাতার ভিত গড়লেন। ধীরে ধীরে সাহেব-মেমসাহেবদের আনাগোনায় বড়দিন হয়ে উঠল শহরের অন্যতম প্রধান উৎসব, ঠিক যেমন দুর্গাপুজো। তবে এই উৎসব কেবল ইংরেজদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কাজের লোক, বাঙালি বাবু, ব্যবসায়ী, কর্মচারী, সবার ছোঁয়ায় বড়দিনে যোগ হয়েছিল দেশীয় রং।
সেই সময়ের বড়দিনে দেখা যেত এক অনন্য সামাজিক রীতি, ‘ডলি’ বা ‘ভেট’। দুর্গাপুজোর মতোই দেশীয় কর্মচারীরা তাঁদের সাহেব মনিবদের ফল, মিষ্টি, কেক, মাছ-মাংস পাঠাতেন। আবার মনিবরাও ফিরিয়ে দিতেন পার্বণী বা বকশিশ। এই আদান-প্রদানের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল এক ধরনের সামাজিক সম্পর্ক, যা ছিল
ধর্মের গণ্ডি ছাপিয়ে মানবিকতার বন্ধনে বাঁধা।
বড়দিন উপলক্ষে সজ্জিত কলকাতা রাস্তাঘাটের একটি ছবি
বড়দিন উপলক্ষে শহর সেজে উঠত আলো, ফুল আর সাজে। চৌরঙ্গি, ডালহৌসি, চীনাবাজার, সব জায়গাতেই
উৎসবের আমেজ। ইউরোপীয় দোকানের পাশাপাশি দেশীয় বাজারেও ছিল সমান ব্যস্ততা। ঘোড়ায় টানা বগি গাড়িতে সাহেব-মেমরা যেমন বেরোতেন কেনাকাটায়, তেমনই এই উৎসবের রেশ পড়ত বাঙালি সমাজেও। অনেক সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবার সাহেবদের আপ্যায়নে বড়দিনে নাচ-গান ও ভোজের আয়োজন করত, যেখানে ধর্মের চেয়ে অতিথিপরায়ণতাই ছিল মুখ্য।
খাবারেও মিলেছিল এই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। সাহেবদের টেবিলে থাকত টার্কি, প্লাম পুডিং, ক্রিসমাস পাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে, বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারে বড়দিনে কেকের পাশাপাশি রান্না হত পিঠে-পায়েস। বড়দিনের সকালে খোল-করতাল বাজিয়ে খ্রিস্টীয় সংগীত গেয়ে শহর পরিক্রমা করতেন বাঙালি খ্রিস্টানরা, যা কলকাতার বাইরে প্রায় দেখা যেত না।
প্রতীকী ছবি
সময় বদলেছে। সাহেবি কলকাতা হারিয়েছে তার ঔপনিবেশিক জাঁকজমক। কিন্তু বড়দিন রয়ে গেছে, আরও বিস্তৃত, আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে। আজ বড়দিন মানে শুধু গির্জার প্রার্থনা নয়; মানে ময়দানে পরিবার নিয়ে ঘোরা, নিউমার্কেট থেকে কেক কেনা, পার্ক স্ট্রিটের আলো দেখা। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই মিলে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়াই আজকের কলকাতার বড়দিন।
তবু ইতিহাসের সেই পুরনো দিনের ছোঁয়া পেতে গেলে এখনও যেতে হয় বো ব্যারাকে, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজের ছোট্ট পরিসরে, যেখানে বড়দিন আজও বাঁচিয়ে রেখেছে অতীতের স্মৃতি আর সম্প্রীতির ঐতিহ্য।
বড়দিন উপলক্ষে সজ্জিত কলকাতা রাস্তাঘাটেরএকটি ছবি
কলকাতার বড়দিন তাই শুধু একটি উৎসবের গল্প নয়। এটি এমন এক শহরের কাহিনি, যেখানে নানা ধর্ম, নানা সংস্কৃতি, নানা মানুষের জীবন একসঙ্গে মিশে গিয়ে উৎসবকে করেছে সর্বজনীন। সেকাল থেকে একাল, বড়দিন কলকাতায় সম্প্রীতিরই আরেক নাম।