মানবতার পক্ষে একজোট কণ্ঠ: বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদে মহারাষ্ট্রের মুসলমানরা

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 11 h ago
বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদে মহারাষ্ট্রের মুসলমানরা
বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদে মহারাষ্ট্রের মুসলমানরা
 
ভক্তি চালক

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া দুই হিন্দু যুবকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে মহারাষ্ট্রের মুসলিম সমাজে তীব্র ক্ষোভ ও শোকের ঢেউ উঠেছে। এই ঘটনাগুলি শুধু মানবতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেনি, বরং ধর্মের নামে সহিংসতার বিরুদ্ধে এক গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ময়মনসিংহ জেলায় ২৫ বছর বয়সি দীপু চন্দ্র দাসকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁর দেহ হাইওয়ের ওপর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে রাজবাড়ি জেলার পাংশা এলাকায় আরেকটি ভয়াবহ ঘটনায় ২৯ বছর বয়সি অমৃত মণ্ডলকে জনতা পিটিয়ে হত্যা করে।
 
এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলি আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভারত সরকারও কূটনৈতিক স্তরে এই ঘটনার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। এদিকে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন মুসলিম বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতা ও সমাজকর্মীরা ‘আওয়াজ–দ্যা ভয়েস’-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তাঁদের গভীর দুঃখ, ক্ষোভ এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
 
বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটি দৃশ্য, কর্মী দীপু চন্দ্র দাস
 
‘সদ্ভাব মঞ্চ জন আন্দোলন’-এর মহারাষ্ট্র রাজ্য সমন্বয়ক ইব্রাহিম খান বলেন, “একজন মুসলমান হিসেবে বাংলাদেশে দুই হিন্দু যুবকের হত্যাকাণ্ডের আমি তীব্র নিন্দা জানাই। বাংলাদেশ যেহেতু একটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, তাই সেখানকার মুসলমানদের দায়িত্ব আরও বেশি, ইসলামের প্রকৃত ও মানবিক চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা।”
 
তিনি আরও বলেন, “ইসলাম সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। ইসলামী শাসনের ইতিহাসে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাই বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা কোনওভাবেই ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য বাংলাদেশ সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী সংখ্যালঘু সুরক্ষার উদাহরণ স্থাপন করতে হবে।”
 
পুনের হাডাপসার এলাকার গুলশান-এ-গরিব নওয়াজ মসজিদের ইমাম মৌলানা মোহাম্মদ তৌকীর আশরাফি বলেন, “দুই নিরপরাধ হিন্দু যুবকের ওপর জনতার হামলার খবর অত্যন্ত বেদনাদায়ক। একজন ইমাম হিসেবে আমি এই ঘটনার তীব্র বিরোধিতা ও নিন্দা জানাই। এটি সম্পূর্ণভাবে ইসলাম ও কোরানের শিক্ষার পরিপন্থী।”
 
তিনি আরও বলেন, “ইসলাম কোনও মুসলমানকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও নিরপরাধ মানুষকে হত্যা বা নির্যাতনের অনুমতি দেয় না। আমি গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি এবং এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আমি চাই, ভারত সরকার রাজনৈতিক স্তরে হস্তক্ষেপ করে এমন সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ নিক।”
 
অমৃত মণ্ডল ও বাংলাদেশের পরিস্থিতির একটি দৃশ্য
 
ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের সচিব কাজি হায়দারের ত্রয়োদশ বংশধর কাজি সোহেল শেখ বলেন, “যখন কোনও মুসলমান এ ধরনের জঘন্য কাজ করে, তখন আমাদের মাথা লজ্জায় নত হয়ে যায়। ইসলাম মানবতা, শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। ধর্ম যাই হোক, মানবতাই সবার ঊর্ধ্বে। কোনও ধর্মই হত্যা বা হিংসাকে সমর্থন করে না। যারা এই সহিংসতা ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
 
আমন-ও-ইত্তেহাদ ট্রাস্টের সম্পাদক দিলাওয়ার শেখ বাংলাদেশের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তারা সেই অবদান ভুলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা বেড়েছে। মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরা তাদের দায়িত্ব। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এই ধরনের ঘটনা ইসলামে কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
 
নবী মহম্মদের যুগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “‘মিসাক-ই-মদিনা’ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সুরক্ষার সর্বোত্তম উদাহরণ। নবীজি আমাদের জন্য এই আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের শাসকরা যেন সেই শিক্ষা ভুলে গেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং নিহতদের পরিবারকে ন্যায্য সহায়তা প্রদান করতে হবে।”
 
ইলাহি ফাউন্ডেশনের পয়গম্বর শেখ বলেন, “ভারতের মুসলিম সমাজ বাংলাদেশের হিন্দুদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের ওপর হওয়া অত্যাচার কোনও পরিস্থিতিতেই সমর্থনযোগ্য নয়। মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকেই এর তীব্র নিন্দা জানানো প্রয়োজন। ধর্মের নামে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক স্তরে চাপ সৃষ্টি করা উচিত।”
 
প্রতীকী ছবি
 
মিস ফারাহ চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. ফারাহ শেখ বলেন, “বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এই অমানবিক ঘটনাগুলি আমাদের হৃদয়কে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এগুলি শুধু সংবাদ নয়, মানবতার ওপর সরাসরি আঘাত। ধর্মের নামে হত্যা এক জঘন্য অপরাধ। ইসলাম মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখে, তার জাত, ধর্ম বা পরিচয় নির্বিশেষে। আমরা ভারতীয় মুসলমানরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।”
 
সমাজকর্মী আনোয়ার শেখ বলেন, “ভারতের মূল পরিচয় সহাবস্থান ও সম্প্রীতি। মুসলমান, হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, সবাই মিলেই এই দেশ গড়ে তুলেছে। তাই আমরা স্পষ্টভাবে বলছি, আমাদের হিন্দু ভাইদের বিরুদ্ধে সহিংসতা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আজ নীরব থাকা মানে অন্যায়কে সমর্থন করা।”
 
সব মিলিয়ে, এই নৃশংস ও অমানবিক ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় মুসলিম সমাজ গভীর ক্ষোভ, শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সব বুদ্ধিজীবী ও সমাজনেতার অভিমত এক, ইসলাম শান্তির ধর্ম, নিরপরাধ মানুষের হত্যার কোনও স্থান এতে নেই। তাঁরা বাংলাদেশের সরকারের কাছে নিরপেক্ষ তদন্ত, দোষীদের কঠোর শাস্তি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।