মুন্নী বেগম / গুয়াহাটি
সাধারণত ভারতে বড়দিন বলতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোয়ার সমুদ্রতট বা কেরালার রঙিন আলোয় সজ্জিত গির্জার ছবি। কিন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, সাদা কুয়াশায় মোড়া উপত্যকা আর ঢেউখেলা পাহাড়ের কোলে, বড়দিন উদযাপিত হয় এক অনন্য নান্দনিকতায়। যা আজও দেশের অন্যতম অসাধারণ অথচ নীরবে লুকিয়ে থাকা গল্প হয়ে রয়ে গেছে।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বড়দিন কেবল একটি উৎসব নয়; এটি পরিচয়, সম্প্রদায়, সঙ্গীত ও স্মৃতির এক অপূর্ব সম্মিলন। ভারতের বৃহত্তম খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয়, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ এবং অসমের কিছু অঞ্চলে বসবাস করে। এই অঞ্চলের বহু জনগোষ্ঠীর কাছে খ্রিস্টধর্ম শুধু একটি ধর্মীয় বিশ্বাস নয়; বরং তা সামাজিক পরিবর্তন, শিক্ষা, লিপি-সংস্কার ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ খুলে দিয়েছে। সেই কারণেই এখানে বড়দিন উদযাপিত হয় গভীর আন্তরিকতা নিয়ে, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উভয় অর্থেই।
শিলংয়ে বড়দিনের প্রস্তুতির একটি দৃশ্য
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গ্রামগুলোতে বড়দিনের প্রস্তুতি শুরু হয় কয়েক সপ্তাহ আগেই। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গির্জায় সঙ্গীত অনুশীলনে ব্যস্ত থাকে গায়কদের দল। কারণ, সঙ্গীতই উত্তর-পূর্বের বড়দিনের হৃদস্পন্দন। উত্তর-পূর্ব যদি বিশ্বকে কিছু উপহার দিয়ে থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে সঙ্গীত। বড়দিনের সময় সেই সঙ্গীত এক জীবন্ত সত্তায় রূপ নেয়। তরুণ-তরুণীরা বয়স্ক ও অসুস্থদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেয়। পুরো পাড়া পরিষ্কার করে সাজিয়ে তোলা হয়। কারণ এখানে বড়দিন জনমানুষের উৎসব, এটি বাণিজ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।
নাগাল্যান্ডের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বড়দিনে কোরাল গান, গিটারের ঝংকার আর সুরের মেলবন্ধনে চারপাশ প্রতিধ্বনিত হয়। প্রতিটি বাড়িতে কোরালের প্রস্তুতি চলে। গির্জার দলগুলো ঘরে ঘরে গিয়ে গভীর শীতের রাত পর্যন্ত গান পরিবেশন করে।
মিজোরামের বড়দিনের একটি দৃশ্য
একইভাবে মেঘালয়ে বড়দিনে ইউরোপীয় সঙ্গীতসংস্কৃতির ছোঁয়া দেখা যায়। ‘ভারতের সঙ্গীত রাজধানী’ নামে পরিচিত শিলং শহর যেন রূপ নেয় লাইভ কনসার্টের মঞ্চে। গির্জা ও যুবগোষ্ঠীগুলো বহুস্তরীয় কোরাল, ভায়োলিন ও কিবোর্ডের সুরে বড়দিন উদযাপন করে, যেখানে প্রতিফলিত হয় পাশ্চাত্য ধ্রুপদি ঐতিহ্য।
অন্যদিকে মিজোরামে বড়দিন মানেই প্রতিটি অঞ্চলে নিজস্ব সঙ্গীতানুষ্ঠান। শক্তিশালী কোরাল দলগুলোর গানে হাজার হাজার কণ্ঠ একসঙ্গে হৃদস্পন্দনের মতো উত্থিত হয়।
নাগাল্যান্ডে বড়দিন উদযাপনের একটি দৃশ্য
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বড়দিনের খাবার কেবল রেস্তোরাঁর মেনু নয়; এটি উপজাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। ধীরে ধীরে রান্না করা, ভাগাভাগি করে খাওয়া শতাব্দীপ্রাচীন খাদ্যসংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই উৎসব।
নাগাল্যান্ডে বাঁশে ভাজা শূকরের মাংস, গাঁজানো সয়াবিনের পদ, স্টিকি রাইস ও তাজা বনজ ভেষজ বড় কাঠের পাত্রে রান্না হয়, যা পুরো গ্রাম একসঙ্গে ভাগ করে খায়। মিজোরামে তাজা শূকরের মাংসের স্টু, সেদ্ধ শাকসবজি ও ‘বাই’ নামের আঠালো চালের ভাত পরিবেশন করা হয়। সেদিন পরিবারগুলো সারাদিন অতিথিদের জন্য ঘরের দরজা খোলা রাখে। মেঘালয়ে গো মাংসের ঘন স্টু, কাঠের আগুনে তৈরি চালের গুঁড়োর পিঠা আর উষ্ণ হাসিতে অতিথিদের স্বাগত জানানো হয়। এই ভাগাভাগির প্রথা কাকতালীয় নয়, এটি সংস্কৃতির অংশ, যা সমতা, পরিবারবোধ এবং এই বিশ্বাসকে তুলে ধরে যে বড়দিনে কেউ একা থাকবে না।
নাগা আদিবাসী স্টিকি রাইস কেক
ভারতের বড় শহরগুলোতে যেখানে প্লাস্টিকের সাজসজ্জা চোখে পড়ে, উত্তর-পূর্বে সেখানে বড়দিন উদযাপিত হয় প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে। বন থেকে আনা পাইন গাছ, হাতে তৈরি বাঁশের তারা, কাচের জারে ছোট মোমবাতি, শিশুদের আঁকা শিল্পকর্ম ও রঙিন ফুলে সাজানো হয় বাড়ি ও গির্জা। প্রতিদিন গির্জাগুলো রঙিন আলোয় ঝলমল করে ওঠে।
মধ্যরাতের প্রার্থনাসভা এখানে বড়দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদিও আচার আলাদা, তবুও এই সমাবেশ এক বিশাল সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কোরাল প্রতিযোগিতা, বাইবেলের নাটক, যুবসমাজের নেতৃত্বে রাস্তায় শোভাযাত্রা, সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। স্থানীয় আদিবাসী ভাষায় প্রার্থনা হয়, দাদিরা ঐতিহ্যবাহী শাল জড়িয়ে আসেন, শিশুরা পরম্পরাগত পোশাক পরে, আর তরুণ-তরুণীরা গভীর রাত পর্যন্ত গান গেয়ে রাস্তায় আনন্দ ছড়ায়।
পাইন গাছ
এখানকার বিশ্বাস কঠোর বা আনুষ্ঠানিক নয়; তা আনন্দময় ও গভীরভাবে সাম্প্রদায়িক। বড়দিনে এখানে কেনাকাটা নয়, দেওয়ার প্রথাই মুখ্য। ‘দান’-এর ধারণাটিই উত্তর-পূর্বের বড়দিনের মূল চেতনা। তরুণরা অনাথ আশ্রমে যায়, গির্জা থেকে কম্বল ও খাবার বিতরণ করা হয়, প্রতিবেশীরা হাতে তৈরি মিষ্টি ভাগ করে নেয়, ছাত্রছাত্রীরা বৃদ্ধদের ঘর সাজাতে সাহায্য করে। এখানে কোনো ব্র্যান্ডের জৌলুস নেই, সবাইকে আপন করে নেওয়াই আসল কথা।
বরফ না থাকলেও উত্তর-পূর্বের বড়দিন যেন এক শীতের রূপকথা। পাহাড়ি হাওয়া, পাইন গাছে জমে থাকা কুয়াশা, নীরব উপত্যকার ওপর ঝিলমিল করা তারা, আর দূরে কারও গুনগুনিয়ে গান, সব মিলিয়ে এমন এক শান্তি পাওয়া যায়, যা বড়দিনকে বাণিজ্যিক কোলাহল থেকে দূরে রেখে বিশুদ্ধ করে তোলে।
হাতে তৈরি বাঁশের তারা, ছোট ছোট মোমবাতির কাঁচের বয়াম
উত্তর-পূর্বের বড়দিন ভারতের অন্যতম প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক সম্পদ। এটি আমাদের শেখায়, উৎসব মানে সম্প্রদায়, সঙ্গীত, সরলতা, দয়া ও একসঙ্গে থাকা। প্রতিটি আলোকিত গির্জা, প্রতিটি খাবারের থালা, তারাভরা আকাশের নিচে গাওয়া প্রতিটি সুর আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বড়দিনের গভীরে লুকিয়ে আছে মানবতা।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বড়দিন এমন এক উৎসব, যেখানে বিশ্বাস মিশে যায় সংস্কৃতির সঙ্গে, পরম্পরা মেলায় ভালোবাসার সঙ্গে, আর যেখানে শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবার কণ্ঠই হয়ে ওঠে এক মহাসমন্বয়ের গান।