ক্যামেরার আড়ালে মানবতা: সালমান খানের অচেনা পরিচয়

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 1 d ago
সালমান খানের জন্মদিন উপলক্ষে
সালমান খানের জন্মদিন উপলক্ষে
 
অনিকা মহেশ্বরী / নয়াদিল্লি

সালমান খান, বলিউডের এমন এক নাম, যিনি প্রায়শই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন। তবুও একটি সত্য অস্বীকার করা যায় না, এমনকি তাঁর কঠোরতম সমালোচকরাও যা অস্বীকার করতে পারেন না, তা হলো দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ সহানুভূতি ও সাহায্যের হাত। বছরের পর বছর ধরে সালমান খান বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন, কারও চিকিৎসার প্রয়োজন হোক, আর্থিক সহায়তা দরকার হোক কিংবা মানসিক শক্তির প্রয়োজন, তিনি প্রায়শই চলচ্চিত্র জগত থেকে এগিয়ে আসা প্রথম ব্যক্তিদের একজন।
 
সালমান খান কখনওই তাঁর সমাজসেবামূলক কাজের প্রচার করেননি। অথচ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসা অসংখ্য গল্প স্পষ্ট করে দেয়, কীভাবে তিনি নীরবে হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেছেন, ব্যয়বহুল চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং বহু মানুষকে নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
 
সালমান খান
 
বিং  হিউম্যান: আশা, সহায়তা ও মর্যাদার প্রতীক
 
২০০৭ সালের ১৪ জানুয়ারি সালমান খান প্রতিষ্ঠা করেন বিং হিউম্যান ফাউন্ডেশন। আজ এই সংস্থাটি ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী সেলিব্রিটি-অনুপ্রাণিত সামাজিক সংগঠন হিসেবে গণ্য হয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে কাজ করা এই ফাউন্ডেশন হাজার হাজার পরিবার, শিশু ও অসহায় মানুষের জন্য আশার আলো হয়ে উঠেছে।
 
বিং হিউম্যানের অধীনে দরিদ্র ও মেধাবী শিশুদের শিক্ষার খরচ বহন করা হয়, গুরুতর অসুস্থ রোগীদের বিনামূল্যে বা আংশিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিতদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের সহায়তা করা হয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাৎক্ষণিক ত্রাণ প্রদান করা হয়। বিং হিউম্যান কেবল একটি এনজিও নয়, বরং এটি একটি টেকসই মডেল। ২০০৯ সালে এইচডিআইএল কৌতুর উইকে বিং হিউম্যান পোশাক ব্র্যান্ডের সূচনা হয়, যার লক্ষ্য ছিল, বিক্রয়লব্ধ অর্থ সরাসরি সমাজসেবামূলক কাজে বিনিয়োগ করা।
 
সালমান খানের রক্তদানের একটি ছবি
 
অস্থিমজ্জা দান: এক ঐতিহাসিক মানবিক পদক্ষেপ
 
সালমান খানের অন্যতম উল্লেখযোগ্য মানবিক উদ্যোগ হলো অস্থিমজ্জা দান। ২০১০ সালে তিনি এমডিআরআই (ম্যারো ডোনারস রেজিস্ট্রি ইন্ডিয়া)-র সঙ্গে অংশীদারিত্ব করে ভারতের প্রথম সেলিব্রিটি অস্থিমজ্জা দাতা হিসেবে পরিচিত হন। এই পদক্ষেপ হাজার হাজার মানুষকে সচেতন করেছে যে, অস্থিমজ্জা দান মারাত্মক রোগে আক্রান্ত শিশুদের জীবন বাঁচাতে পারে।
 
বছরের পর বছর ধরে সমাজসেবামূলক উদ্যোগ
 
* ২০১২: মুম্বইয়ের অক্ষরা হাইস্কুলের ২০০ শিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণ খরচ বহন।
 
* ২০১৩: ‘লিটল হার্টস প্রোগ্রাম’-এর অধীনে জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা।
 
* ২০১৩: মহারাষ্ট্রের খরাপীড়িত এলাকায় ২৫০০টি পানির ট্যাঙ্ক স্থাপন।
 
* ২০১৪: স্বচ্ছ ভারত অভিযানের আওতায় জনসাধারণের জন্য শৌচাগার নির্মাণ।
 
* ২০১৫: কাশ্মীরের বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ৩০ হাজার উলের কম্বল বিতরণ।
 
* ২০১৭: শ্রীনগরের ফাট সেন্টার, মুখের বিকৃতি থাকা শিশুদের জন্য বিনামূল্যে অস্ত্রোপচার।
 
* ২০২০–২১: কোভিড-১৯ মহামারির সময় চলচ্চিত্র জগতের ২৫ হাজার কর্মীকে আর্থিক সহায়তা।
 
* ২০২৪–২৫: পাঞ্জাবের বন্যাকবলিত গ্রামগুলির জন্য ত্রাণসামগ্রী ও নৌকা প্রদান।
 
শিশুদের সঙ্গে সালমান খানের একটি ছবি
 
আত্মবিশ্বাস জাগানো পরিসংখ্যান
 
* ১৪৬৬ জনেরও বেশি শিশুর বিনামূল্যে হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচার
 
* ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষের চোখ পরীক্ষা
 
* ১৯০০-র বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রশিক্ষণ এবং ১১৯৪ জনের কর্মসংস্থান
 
* শিক্ষা ক্ষেত্রে ৪৫০০-রও বেশি শিশুকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা
 
সম্পদ, ব্যবসা ও সরল জীবনযাপন
 
বলিউডের অভিনয়জীবন উত্থান-পতনে ভরা। প্রতিটি অভিনেতার প্রতিটি ছবি সফল হয় না। তাই অনেক বলিউড অভিনেতার আয়ের উৎস অভিনয়ের বাইরে অতিরিক্ত ব্যবসার মাধ্যমেও গড়ে ওঠে। ৬০ বছর বয়সি সালমান খানের বর্তমান সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ₹৩০০০ কোটি, যার প্রায় অর্ধেক তিনি বিভিন্ন ব্যবসা থেকে উপার্জন করেছেন।
 
অভিনয়ের পাশাপাশি সালমান খান রিয়েল এস্টেট, ফিটনেস ভেঞ্চার ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড থেকেও বিপুল আয় করে থাকেন। ৬০ বছর বয়সে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ₹৩০০০ কোটি বলে অনুমান করা হয়। এই আয়ের বড় অংশ আসে সিনেমার বাইরের ব্যবসায়িক উদ্যোগ থেকে।
 
সালমান খান
 
SK-27 জিম ও ফিটনেস সরঞ্জাম
 
ফিটনেস শুধু সালমান খানের শখ নয়, এটি তাঁর পরিচয়ের অংশ। ২০১৯ সালে তিনি সারা ভারতে SK-27 জিম চেইন চালু করেন। এর পর তিনি নিজস্ব ফিটনেস সরঞ্জামের ব্র্যান্ড শুরু করে নিজের আবেগকে নতুন মাত্রা দেন। এই উদ্যোগ দেশের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য ও ফিটনেস সচেতনতা বাড়িয়ে তুলছে।
 
এছাড়াও ২০১৯ সালে তিনি “বিং স্ট্রং” নামে একটি ফিটনেস ইকুইপমেন্ট রেঞ্জ চালু করেন। মুম্বাই, নয়ডা, ইন্দোর ও কলকাতার মতো বড় শহরে তাঁর একাধিক জিম রয়েছে।
 
সালমান খান প্রোডাকশন হাউস
 
২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত সালমান খান ফিল্মস (SKF) তাঁর নিজস্ব প্রোডাকশন হাউস। এই ব্যানারে ‘চিল্লার পার্টি’ ও ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-সহ একাধিক হিন্দি ছবি নির্মিত হয়েছে। ‘চিল্লার পার্টি’ সেরা শিশু চলচ্চিত্রসহ তিনটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।
 
বিং হিউম্যান ফাউন্ডেশন 
 
২০০৭ সালে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে কাজ করার উদ্দেশ্যে সালমান খান বিং হিউম্যান ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন। এই সংস্থা হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচার, ক্রেনিওফেসিয়াল চিকিৎসা, চোখের শিবির এবং ক্যানসার রোগীদের সহায়তা প্রদান করে। ব্র্যান্ড বিক্রির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ফাউন্ডেশন অনুদান গ্রহণ না করে পোশাক বিক্রির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে। শুরু থেকেই সালমান খান নিজে এই ফাউন্ডেশনের প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে চলেছেন।
 
'বিগ বস' টিভি শো হোস্টিং- এ সালমান খান
 
টিভি শো সঞ্চালনা
 
২০১০ সাল থেকে সালমান খান ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো বিগ বস সঞ্চালনা করে আসছেন। ‘বিগ বস ১৯’-ও তাঁর সঞ্চালনায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সূত্র অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে তিনি ৪৫–৫০ কোটি টাকা পারিশ্রমিক নেন। যদিও প্রযোজকরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই অঙ্ক নিশ্চিত করেননি, কারণ চুক্তিটি সরাসরি জিও হটস্টারের সঙ্গে হয়েছিল। বিগ বসের আগে তিনি “১০ কা ডাম” নামের একটি রিয়েলিটি গেম শোও সঞ্চালনা করেছেন।
 
চিত্রকলা: একটি প্রিয় শখ
 
গান গাওয়ার পাশাপাশি সালমান খান চিত্রকলার প্রতিও গভীর আগ্রহী। তিনি একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী। তাঁর শিল্পকর্ম অত্যন্ত সৃজনশীল। তিনি প্রিয়জনদের নিজের আঁকা ছবি উপহার দেন এবং সেই ছবিগুলি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ বিং হিউম্যান চ্যারিটিতে দান করেন।
 
এক অদ্ভুত শখ: সাবান সংগ্রহ
 
বলিউড সুপারস্টারদের শখ প্রায়ই ব্যতিক্রমী হয়। অনেক তারকার গাড়ি, বাইক কিংবা শিল্পকর্মের বিশাল সংগ্রহ থাকে। কিন্তু সালমান খানের শখ একেবারেই আলাদা, তিনি সাবান সংগ্রহ করতে ভালোবাসেন। সুগন্ধির প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে এবং তিনি বিভিন্ন ধরনের ভেষজ সাবান সংগ্রহ করেন। শোনা যায়, যেখানেই তিনি যান, সেখান থেকেই কিছু না কিছু সাবান কিনে নেন।
 
একাধিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে জড়িত সালমান খানের একটি ছবি
 
‘দবং’ খান ও ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট
 
এছাড়াও সালমান খান সুজুকি, ডাবর, পেপসি অ্যান্ড অ্যাপি ফিজ, রিভাইটাল এইচ, চিংগারি শর্ট ভিডিও অ্যাপ, ডিক্সি স্কট, রোটোম্যাক পেন, হিরো হোন্ডা, ব্রিটানিয়া টাইগার বিস্কুট, রিয়েলমি সহ বহু জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত। এর ফলে তাঁর সম্পদে বিপুল পরিমাণ অর্থ যোগ হয়। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি প্রতিটি বিজ্ঞাপনের জন্য প্রায় ৬–৭ কোটি টাকা পারিশ্রমিক নেন।
 
মানবতাই তাঁর আসল পরিচয়
 
কথিত আছে, সালমান খান তাঁর উপার্জনের প্রায় ৯০ শতাংশ সমাজসেবায় দান করেন। অন্যদিকে তিনি নিজে অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন পছন্দ করেন। বিতর্ক ও সমালোচনা যে কোনো বড় নামের সঙ্গেই থাকে, কিন্তু সালমান খানের নিরবচ্ছিন্ন মানবিক কাজ প্রমাণ করে, তাঁর মধ্যে সহানুভূতি ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গভীরভাবে প্রোথিত। ৬০ বছর বয়সে সালমান খান কেবল একজন সুপারস্টার নন, বরং এমন একজন মানুষ, যিনি সাহায্যের জন্য সবসময় প্রস্তুত। আর সেটাই হয়তো তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়।