শুকনো মাছের ব্যবসায় স্বনির্ভর এক গ্রাম ও এক মহিলার সংগ্রামের গল্প

Story by  Munni Begum | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 3 d ago
নুরানী বেগম
নুরানী বেগম
 
মুন্নী বেগম, গুয়াহাটিঃ

শুকনো মাছের ঘ্রাণে ভরপুর একটি গ্রাম।এটি যেন একটি বিশেষ সুগন্ধে মোড়া। অসমের এই গ্রামের মাটিতেই যেন মিশে আছে মাছের স্বাদ আর ঘ্রাণ। এখানে কেউ একবার আসলে, মাছপ্রেমী না হয়েও মুগ্ধ না হয়ে থাকতে পারবেন না। কারণ, সারা বছর জুড়ে পাওয়া যায় নানা ধরনের শুকনো মাছ।

এই ব্যবসার উপরই নির্ভরশীল গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার। গ্রামটির নাম বেপারীপাড়া, যা গুয়াহাটি থেকে প্রায় ২৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দক্ষিণ শালমারাতে।  নুরানী বেগম শুকনো মাছের ব্যবসার মাধ্যমে কেবল নিজেকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তুলেছেন তা নয়—তাঁর পরিবারকেও তিনি সযত্নে আগলে রেখেছেন।
 ‘অসমী সারস মেলা’য় সুযোগ, শুকনো মাছকে নিয়ে বহুদূর এগোতে চায় নুরানী বেগম।ভারত সরকারের গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনের (National Rural Livelihood Mission - NRLM) উদ্যোগে  আয়োজিত ‘অসমী সারস মেলা’-য় এক বিপণন স্টলের মাধ্যমে নুরানী বেগম পেয়েছেন তার শুকনো মাছকে সারা অসম এবং দেশের অন্যান্য প্রান্তের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক দুর্লভ সুযোগ।

‘আওয়াজ - দ্যা  ভয়েস অসম’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নুরানী বেগম বলেন,"আমি যতদূর মনে করতে পারি, ছোটবেলা থেকেই শুকনো মাছের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বছরের সবসময়ই আমরা ক্রেতাদের মাছ সরবরাহ করতে পারি—তার জন্যই মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা করি। কারণ, শুকনো মাছ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে দুই বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। আমার মতো, আমাদের গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বর্ষাকালে আমরা বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রচুর তাজা মাছ কিনি, পাশাপাশি নিজেরাও খাল, বিল, নদী থেকে মাছ ধরে শুকিয়ে রাখি।"

স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাওয়া মহিলারা নুরানী বেগমের এই ব্যবসা শুধু তাকে নয়, বরং তার গোটা গ্রামের আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে মজবুত করছে। এমন আয়োজনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে তিনি যেমন আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন, তেমনি স্থানীয় পণ্যকে জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছানোর একটা দরজা খুলে গেছে।

মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করা একটি অতি প্রাচীন প্রথা। কারণ, পুরনো দিনে সংরক্ষণ করে রাখার মতো ফ্রিজের মতো কোনো জিনিস ছিল না, যার ফলে সতেজ মাছ বেশি সময় সংরক্ষণ করে রাখা সম্ভব হতো না। তাই দীর্ঘদিন মাছ সংরক্ষণ করার জন্য সতেজ মাছগুলো শুকিয়ে রাখা হতো। এই প্রথাটি বর্তমানে বেপারীপাড়া গ্রামের লোকজনের জীবিকার একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা অসম ছাড়াও উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে শুকনো মাছ সরবরাহ করে আসছেন।
 

 
নুরানী বেগমের শুকনো মাছ
 
নুরানী বেগম বলেন, "আমাদের এখানে বর্ষা হোক কিংবা খরা,সবসময়ই শুকনো মাছ পাওয়া যায়। আমরা বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সংগ্রহ করা সতেজ মাছগুলোর পেট ফাড়িয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিই। এরপর মাঠে চাঙ পেতে তার ওপর পাটি বিছিয়ে মাছগুলো রোদে শুকাতে দিই। মাছগুলো ভালোভাবে শুকিয়ে গেলে ১০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের প্যাকেট তৈরি করে বাজারে ক্রেতাদের জন্য ছেড়ে দিই। আমরা প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত মাছ শুকাই। এই কাজে আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্য হাতে-কলমে সাহায্য করেন।"

 সোনালী আত্মসহায়ক গোষ্ঠীর সদস্য নুরানী বেগম বিশেষভাবে বামলা মাছ, ছুরি মাছ, নাকটুরা, চিংড়ি মাছ, কেশকি মাছ, চেলেকনি মাছ, মোয়া মাছ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখেন। শুধু মাছ শুকানোই নয়, তারা শুঁটকি মাছ থেকে শিদল (এক ধরনের গাঁজানো শুকনো মাছ) তৈরিও করেন। কারণ, নুরানী বেগমের মতে, গ্রাহকদের মধ্যে শিদলের চাহিদা অনেক বেশি।

নুরানী বেগম বলেন, "আমি মাছগুলো আগুনে না দিয়ে কেবল রোদেই শুকাই। কারণ,আগুনে ভালোভাবে শুকাতে গেলে মাছের রঙ বদলে যায় এবং ধোঁয়ার একটা গন্ধ তৈরি হয়। এতে মাছের স্বাদেও কিছুটা পরিবর্তন আসে। কিন্তু রোদে শুকনো মাছের স্বাদ অনেক ভালো হয়। রোদে শুকানোর আরও একটি সুবিধা হলো একসাথে অনেক মাছ শুকানো যায়, যেখানে আগুনে একসাথে খুব অল্পই শুকানো সম্ভব।

আমরা কিছু মাছ শুকানোর সময় লবণ ব্যবহার করি। আবার, যদি রোদের তাপ কম থাকে, তখন কিছু মাছ আগে সিদ্ধ করে তারপর শুকাতে হয়। না হলে সেই মাছগুলো খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।"বছরে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা নুরানী বেগম অসম-মেঘালয় সীমান্তবর্তী দক্ষিণ শালমারার প্রতিটি সাপ্তাহিক হাটে শুকনো মাছ বিক্রি করতে যান। প্রতি হাটে ৩০ থেকে ৪০ কেজি পর্যন্ত মাছ ক্রেতারা তাদের কাছ থেকে কেনেন, ফলে একেকটি হাটে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি তার ছেলে আখতার হুসেইনের সঙ্গে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত মেলাগুলিতেও মাছ বিক্রি করতে যান। সেখানে তাদের কাছ থেকে ৫০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত দামের মাছ পাওয়া যায়।
 

শুকনো মাছের পেকেট
 
নুরানী বেগম বলেন, "শুকনো মাছের ব্যবসা খুবই ভালো। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই ব্যবসার উপর নির্ভর করেই জীবনযাপন করছে। পুরো বছরের জন্য আমরা ১০ থেকে ২০ কুইন্টাল মাছ সংরক্ষণ করে রাখি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মাছগুলি যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য চাঙ পেতে সংরক্ষণ করে রাখি। মাছগুলিতে যেন পোকা না লাগে, সে কারণে চাঙের নিচে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করি। আমার পুরো পরিবার এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাছ পরিষ্কার করা, ধোয়া, শুকানো এবং প্যাকেট বানানোর সমস্ত কাজ আমরা নিজেরাই বাড়িতে করি।"

উল্লেখ্য, প্রায় ৫০০টি পরিবার নিয়ে গঠিত দক্ষিণ শালমারার বেপারীপাড়া গ্রামে প্রায় ৪০০টি পরিবারই শুকনো মাছের ব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছে। এই ব্যবসার মাধ্যমেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে।