তেহমিনা পুনওয়ানি (বাম থেকে দ্বিতীয়) সালমান খুরশিদ এবং মনীশ তিওয়ারির সাথে বইটি প্রকাশের একটি মুহূর্ত
অশহার আলম / নয়া দিল্লি
তেহমিনা পুনওয়ানি তাঁর নানী (দিদিমা) জীবনের এক বিরল দৃষ্টান্ত সামনে আনলেন। তাঁর নানী, বেগম কুদসিয়া রাসুল, ছিলেন ১৯৪৯ সালে ভারতের সংবিধান প্রণয়নকারী গণপরিষদের একমাত্র মুসলিম মহিলা সদস্য, এক সত্যিই অসাধারণ নারী। অনুষ্ঠানটি ছিল বেগম কুদসিয়া রাসুলের বই প্রকাশ, তাঁর মৃত্যুর ২৪ বছর পর।
তেহমিনা পুনওয়ানি, যিনি পেশায় আইনজীবী, বেগম কুদসিয়া রাসুলের মেয়ের মেয়ে। দিল্লিতে বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তেহমিনা বলেন, “দুনিয়ার কাছে তিনি ছিলেন এক নির্ভীক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু আমার কাছে তিনি ছিলেন আমার আম্মিজান, স্নিগ্ধ, সংযত ও সততার প্রতীক।”
তিনি স্মরণ করেন সেই সময়কে, যখন জনজীবনে প্রবেশের জন্য কুদসিয়া রাসুলের বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া জারি করা হয়েছিল। পরিবার ভীত হলেও রাসুল ছিলেন শান্ত ও স্থিরচেতা। “যদি আমার বিবেক নির্মল থাকে, কোনো ফরমান আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না”, এ কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, এবং এই স্মৃতিচারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত শ্রোতারা করতালিতে মুখরিত হন।
“Begum Qudsia Rasul-The Remarkable Life Of The Only Muslim Woman In the Constituent Assembly” শিরোনামে নতুনভাবে প্রকাশিত বইটি আসলে তার আত্মজীবনী “From Purdah to Parliament: The Memoirs of a Muslim Woman in Indian Politics”-এর পুনর্মুদ্রণ, যেখানে এই পথিকৃৎ মুসলিম নারী নেত্রীর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবন তুলে ধরা হয়েছে।
“Begum Qudsia Rasul-The Remarkable Life Of The Only Muslim Woman In the Constituent Assembly” শিরোনামে নতুনভাবে প্রকাশিত বইটি
অনুষ্ঠানে সাংবাদিক, আইনজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা একত্রিত হয়েছিলেন, মূলত এমন এক নারীর অবদান স্মরণ করতে, যাকে ভারতীয় মূলধারার ইতিহাস প্রায় বিস্মৃত। সাংবাদিক নিধি রাজদানের সঞ্চালনায় আলোচনাচক্রে অংশ নেন সালমান খুরশিদ, ইন্দিরা জয়সিং, মনীশ তিওয়ারি এবং তেহমিনা পুনওয়ানি।
১৯০৯ সালে জন্ম নেওয়া বেগম কুদসিয়া রাসুল ছিলেন গণপরিষদের একমাত্র মুসলিম মহিলা প্রতিনিধি। তিনি ধর্মীয় সংরক্ষণের বিরোধিতা, সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা এবং মহিলাদের হকির প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি উত্তর প্রদেশ বিধানসভা এবং রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন এবং ২০০০ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৪৬ সালের গণপরিষদে একমাত্র মুসলিম নারী হিসেবে তিনি সংখ্যালঘু সমতা, অধিকার এবং ধর্মীয় সংরক্ষণবিরোধী অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।
কুদসিয়া বেগম উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং তার নামে একটি মহিলা হকি কাপও প্রবর্তিত হয়েছে। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে তিনি জনজীবনে যে সাহসিকতার সাথে পথ তৈরি করেছিলেন, তা ছিল সময়ের তুলনায় বহু এগিয়ে। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি ভ্রমণকাহিনি, "Our Bapu", মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ এবং ভোপালের বেগমদের নিয়ে লেখা Hayat-e-Qudsi।
তেহমিনা জানান, রাজনৈতিক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও কুদসিয়া রাসুল সবসময় সাধারণ মানুষের কাছাকাছি ছিলেন। “তিনি প্রতিদিন নারীদের সঙ্গে দেখা করতেন, তাদের সমস্যা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং বিনা প্রচারে তাদের জন্য কাজ করতেন। তাঁর কাছে আন্দোলন ছিল কর্তব্য, খ্যাতির বিষয় নয়।”
অন্যান্য বক্তারাও স্মরণ করেন, কীভাবে সামাজিক বাধা-বিপত্তির মধ্যেও কুদসিয়া রাসুল দৃঢ়তা ও সৌম্যের সঙ্গে পথ দেখিয়েছিলেন। সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সালমান খুরশিদ বলেন, প্রযুক্তিগত নানা বাধা সত্ত্বেও সাধারণ আসন থেকে ইউনাইটেড প্রভিন্সেস অ্যাসেম্বলিতে তাঁর নির্বাচিত হওয়া ছিল অসাধারণ সাহসের উদাহরণ।
কংগ্রেস সাংসদ মনীশ তিওয়ারি বলেন, “গণপরিষদে তার উপস্থিতি ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনার এক উজ্জ্বল দলিল, এক অস্থির সময়ে যা ছিল ঐতিহাসিক।” প্রবীণ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং তাঁর নৈতিক দৃঢ়তা, স্পষ্টতা এবং সহানুভূতিশীল নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, “তিনি ছিলেন দৃঢ় বিশ্বাস ও বিনয়ের এক বিরল সমন্বয়।” সকল বক্তাই ঐকমত্যে বলেন, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম কুদসিয়া রাসুলকে যথার্থ মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
(এই বইটি প্রকাশ করেছে রোলি বুকস।)