বর্তমান সময়ে 'বাবরের'নামে মসজিদের প্রয়োজন আছে কি?

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 22 h ago
সম্রাট বাবরের স্থাপন করা অযোধ্যার মসজিদটি
সম্রাট বাবরের স্থাপন করা অযোধ্যার মসজিদটি
মাওলানা নূরুল আমিন কাশেমী

পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলায়, 'বাবরের নামে মসজিদ নির্মাণ' বিষয়টি বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়। হুমায়ূন কবীর নামে একজন স্থগিত বিধায়কের নেতৃত্বে চলমান এই আন্দোলনে একাংশ সমর্থন জানাচ্ছে, কিন্তু অন্য একাংশ সমালোচনা করছে।

এই সম্পর্কে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগছে — বাবরের নামে মসজিদ নির্মাণ কি সত্যিই ধর্মীয় প্রয়োজন, নাকি এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের একটি অংশ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ইতিহাস, সামাজিক অবস্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি — এই তিনটি বিষয় একসাথে দেখা জরুরি।

১. ইসলামধর্মে মসজিদ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য কী?

ইসলামে মসজিদ হল — নামাজের স্থান, শিক্ষা বা তালীমের কেন্দ্র, সমাজকে সঠিক দিশা প্রদানের স্থান এবং শান্তি, নৈতিকতা ও মানবতার প্রতীক। মসজিদ নির্মাণ সবসময় বিশ্বাসের কাজ হিসেবে ধরা হয়।
 

বিধায়ক হুমায়ূন কবীর
 
কিন্তু 'প্রয়োজন' নেই এমন স্থানে কেবল নামমাত্র মসজিদ তৈরি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। নবী (ছাঃ) নিজেই বিরোধ, বিভাজন এবং অহংকারের জন্য মসজিদ নির্মাণ করা নিষিদ্ধ করেছেন (মসজিদে দিরার-এর ঘটনায়)। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি আছে—

যেখানে নামাজি আছে, সেখানে মসজিদ থাকা উচিত; যেখানে নামাজি নেই, সেখানে মসজিদের কী প্রয়োজন?

এখন যে বিষয়টি দেখা প্রয়োজন তা হলো, মুর্শিদাবাদে ইতিমধ্যেই বহু পুরনো মসজিদ, মাদ্রাসা এবং ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। সেই স্থানগুলিতে সাধারণ মুসলিম জনগণ নতুন করে 'বাবরের নামে বিশেষ মসজিদ' এর জন্য কোনো দাবি তো দেননি। তাহলে মুর্শিদাবাদে বাবরের নামে মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজন কেন দেখা দিল? এটি বর্তমানে একটি বড় প্রশ্ন।

'বাবরের নামে মসজিদ' বিষয়টি বর্তমান সময়ে ভারতের মুসলমানদের শৈক্ষিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কোনো দিকেই একেবারেই প্রয়োজনীয় নয়। অতএব এই মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্য কী, তা ভাবা জরুরি।

২. 'বাবরের নামে মসজিদ' ইসলামিক দৃষ্টিকোণ

সম্রাট বাবরের স্থাপন করা অযোধ্যার মসজিদ নিয়ে বহু বছর ধরে ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে চলা পুরনো বিবাদ ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। দেশের হিন্দুধর্মী জনসাধারণের আবেগ ও অনুভূতির সম্মান জানিয়ে দেশের সমস্ত মুসলিমরা ন্যায়ালয়ে রাম মন্দিরের পক্ষে দেওয়া রায় মেনে নিয়েছে।

তারপরও যদি কেউ দেশের অন্য কোনো স্থানে বাবরের নামে মসজিদ নির্মাণ করে, তাহলে তার অর্থ হবে পুরনো বিবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটানো এবং কওমের ক্ষতি করা। তাই বিবাদ সৃষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইসলাম কী বলে, তা দেখা যাক—

وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَإِرْصَادًا لِمَنْ حَارَبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ...

অর্থাৎ, যারা (মুসলিমদের) ক্ষতি করার, কুফরী ছড়ানোর, মুমিনদের মধ্যে বিভাজন তৈরির, এবং আগে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ব্যক্তির জন্য ঘাটি নির্মাণ করেছে, তারা হয়তো শপথ করে বলবে, আমরা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে করছি। কিন্তু আল্লাহ সাক্ষী দিয়েছেন যে, তারা প্রকৃতপক্ষে মিথ্যাবাদী। (সূরা তাওবাহ : ১০৭)
 

ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠান

কোরআন পাকের এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, বিবাদ এবং বিভাজন সৃষ্টি করার পাশাপাশি আল্লাহ ও রাসূলের শত্রুদের ফিতনার সুযোগ দেওয়ার জন্য মসজিদ নির্মাণকে পবিত্র কোরআন কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছে।

৩. উম্মতের উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিভঙ্গি:

মুর্শিদাবাদে বাবরের নামে মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে উম্মতের উলামাদের কেউ এ পর্যন্ত সহযোগিতা বা সমর্থন জানায়নি। সকলেই বিরোধিতা করেছেন। বোঝা যায়, এই কাজটি ধর্মীয় প্রয়োজন নয়। যদি এটি ধর্মীয় প্রয়োজন হতো, উলামারা নিশ্চয় সহযোগিতা করতেন, পরামর্শ দিতেন।

বর্তমান পরিস্থিতি, ইতিহাস, সমাজ এবং বাস্তবতা সব দিক পর্যালোচনা করলে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখা যায়— এটি নিয়ে হুলস্থুল, বিতর্ক, উত্তেজনা, সবই কোনো রাজনৈতিক শক্তির ষড়যন্ত্র। ভারতীয় মুসলিম সমাজকে বোঝা দরকার যে, ইসলাম বিভেদের ধর্ম নয়, বরং শান্তি এবং ভ্রাতৃত্বেরই ধর্ম।

অতএব, যেখানে প্রয়োজন আছে, সেখানে অবশ্যই মসজিদ নির্মাণ হওয়া উচিত। যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে অযথা রাজনীতি করলে কওম ও উম্মতের ক্ষতি হওয়া নিশ্চিত।

(লেখক: তেজপুরস্থ Islamic Study & Research Academy Assam-এর সভাপতি)