মোদির ইথিওপিয়া সফর: ‘আফ্রিকা ফার্স্ট’ নীতির কৌশলগত শক্তিবৃদ্ধি

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 3 h ago
ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলীর সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলীর সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
 
রুচিতা বেরি

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইথিওপিয়া সফর আফ্রিকার এই গুরুত্বপূর্ণ দেশটির কৌশলগত গুরুত্ব এবং দুই দেশের ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। হর্ন অফ আফ্রিকায় অবস্থিত ইথিওপিয়ার ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত। পাশাপাশি, আফ্রিকার দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি হিসেবে ইথিওপিয়ার বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রায় ৮.৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূলত বৃহৎ পরিকাঠামো প্রকল্পগুলির মাধ্যমে চালিত হচ্ছে। গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম (GERD) চালু করার মাধ্যমে দেশটি অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক জ্বালানি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনেছে। এই প্রকল্পের ফলে ইথিওপিয়া আফ্রিকার সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ উৎপাদক দেশে পরিণত হওয়ার পথে এগোচ্ছে।
 
এই বাঁধের মাধ্যমে ইথিওপিয়া এবং গোটা হর্ন অফ আফ্রিকা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো প্রকল্প হলো ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিদ্যুতায়িত রেললাইন, যা ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবাকে প্রতিবেশী জিবুতির লোহিত সাগর বন্দরটির সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই রেলপথকে “সমৃদ্ধির অর্থনৈতিক করিডর” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, কারণ এটি স্থলবেষ্টিত দেশটিকে বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে।
জনসংখ্যাগত দিক থেকেও ইথিওপিয়া অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এটি আফ্রিকার দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল দেশ এবং এখানে বিপুল যুব ও প্রাণবন্ত জনসংখ্যা রয়েছে, যা বৃহৎ শ্রমশক্তির সম্ভাবনা তৈরি করে। ইথিওপিয়াতেই আফ্রিকান ইউনিয়নের সদর দফতর অবস্থিত এবং মহাদেশীয় কূটনীতিতে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
 
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ সংঘাত থাকা সত্ত্বেও ইথিওপিয়া আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদারে অব্যাহত ভূমিকা রেখে চলেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে এটি শীর্ষ দশটি সৈন্য প্রেরণকারী দেশের অন্যতম। পাশাপাশি, আল শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে আফ্রিকান ইউনিয়নের সোমালিয়ায় সহায়তা ও স্থিতিশীলতা মিশন (AUSSOM)-এও ইথিওপিয়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা পাঠাচ্ছে।
 
প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফর আফ্রিকার এই গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে সহায়ক হবে। এটি মোদির প্রথম ইথিওপিয়া সফর। সফরকালে তিনি ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে দুই নেতার বৈঠকের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এই সফরটি হচ্ছে।
 
তবে ভারত ও ইথিওপিয়ার সম্পর্ক নতুন নয়। এই সম্পর্কের শিকড় খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর অ্যাক্সুমাইট সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই সময়ে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য চলত, ভারত থেকে রেশম ও মশলার বিনিময়ে ইথিওপিয়া থেকে সোনা ও হাতির দাঁত আমদানি করা হতো। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে ইথিওপিয়াই প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে ভারতে কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করে। পরবর্তী কয়েক দশকে উন্নয়ন সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
 
আফ্রিকায় ভারতের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন সহযোগী দেশ হলো ইথিওপিয়া। গ্রামীণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও চিনিকল উন্নয়নসহ বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পের জন্য দেশটি ভারতের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ সহায়তা পেয়েছে। আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতো ইথিওপিয়ার ক্ষেত্রেও ভারতের উন্নয়ন সহযোগিতা দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা (SSC) কাঠামোর উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়।
 
ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলীর সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
 
এই SSC কাঠামো প্রধানমন্ত্রী মোদির “ভারত–আফ্রিকা সম্পর্কের দশটি দিকনির্দেশক নীতি”-র অন্যতম ভিত্তি। এই নীতির মূল বার্তা হলো, ভারতের উন্নয়ন সহযোগিতা আফ্রিকার নিজস্ব অগ্রাধিকার অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
 
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ভারত ও ইথিওপিয়ার দীর্ঘদিনের অংশীদারিত্ব রয়েছে। ইথিওপিয়ার স্কুল শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠন ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতীয় শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ভারতীয় শিক্ষকরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। বর্তমানে ২০০০-রও বেশি ভারতীয় শিক্ষক সামাজিক বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইথিওপিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। ভারতীয় সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পরিষদ (ICCR)-এর বৃত্তির মাধ্যমে বহু ইথিওপীয় শিক্ষার্থী ভারতে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি, ভারতীয় কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা (ITEC) প্রশিক্ষণ কর্মসূচির অন্যতম বৃহৎ উপভোক্তা দেশ হলো ইথিওপিয়া।
 
ভারত বর্তমানে ইথিওপিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। দেশে ৬৫০টিরও বেশি ভারতীয় সংস্থা কার্যরত, যারা ইথিওপিয়ার বেসরকারি ক্ষেত্রে বৃহত্তম নিয়োগদাতা হিসেবে পরিচিত। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারত-ইথিওপিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের প্রধান রপ্তানি পণ্য হলো ওষুধ, আর আমদানির মধ্যে রয়েছে ডাল ও বীজ। আশা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত হবে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও বাড়বে।
 
ভারত ইথিওপিয়ায় হারার মিলিটারি একাডেমি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই একাডেমি ইথিওপিয়া ও অন্যান্য আফ্রিকান দেশের সামরিক অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যদিও পরবর্তীতে এটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। তবুও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে এবং ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে তা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। মোদির সফরে সাইবার নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা আরও জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
 
বহুপাক্ষিক ক্ষেত্রেও ভারত সবসময় গ্লোবাল সাউথের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করে এসেছে। আগামী বছর ভারত ব্রিকস ফোরামের সভাপতিত্ব করতে চলেছে। এই সফর দুই দেশের নেতাদের মধ্যে ব্রিকসের অভ্যন্তরীণ সহযোগিতা নিয়ে মতামত সমন্বয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। পাশাপাশি, বহুদিন ধরে বিলম্বিত চতুর্থ ভারত–আফ্রিকা ফোরাম সম্মেলন আয়োজনের সম্ভাবনাও আলোচনায় আসতে পারে।
 
সবশেষে বলা যায়, বৈশ্বিক অস্থিরতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা এবং চিনের ঋণ-ফাঁদ কূটনীতির প্রেক্ষাপটে ইথিওপিয়ার মতো অংশীদারদের সঙ্গে ভারতের ধারাবাহিক সংযোগ তার “আফ্রিকা ফার্স্ট” নীতির যথার্থতা প্রমাণ করে, যা পারস্পরিক কল্যাণের জন্য জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি ভাগ করে নেওয়ার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
 
(লেখক: সিনিয়র ফেলো, বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন, নয়াদিল্লি)