মোহাম্মদ মোহসিনের প্রতিষ্ঠিত হুগলি মোহসিন কলেজের ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি ছবি (ফাইল)
মালিক আসগর হাশমি / নয়া দিল্লি
লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘বন্দে মাতরম্’ বিষয়ে দেওয়া প্রভাবশালী বক্তব্য হঠাৎই আনন্দমঠ এবং এর মহান রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে আবারও জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। এর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আগ্রহ বেড়ে গেছে এই প্রশ্নে, বঙ্কিমচন্দ্র কোথায় শিক্ষা লাভ করেছিলেন, কোন অভিজ্ঞতাগুলি তাঁর মধ্যে সেই সাহিত্যিক চেতনার জন্ম দিয়েছিল, যা ভারতকে ‘বন্দে মাতরম্’-এর মতো অমর জাতীয় গান উপহার দিয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই আজ আমরা আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি সেই ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, যেখানে তাঁর উচ্চশিক্ষার সূচনা, হুগলি মোহসিন কলেজ, যা এক মুসলিম পরোপকারী মোহাম্মদ মোহসিন ১৮৩৬ সালের ১ আগস্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৮৩৮ সালের ২৭ জুন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কাঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্কুলশিক্ষা শেষ করার পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন হুগলি মোহসিন কলেজে। সেই সময়ে এটি বাংলার উচ্চশিক্ষার একটি বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল। যদিও তিনি বি.এ. ডিগ্রি পরে ১৮৫৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্জন করেছিলেন, কিন্তু মোহসিন কলেজে তাঁর পড়াশোনা তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এবং সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা নিয়েছিল। এখানেই তিনি ইংরেজি, ইতিহাস, দর্শন ও বাংলা সাহিত্যের গভীর অনুধাবন গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে তাঁর রচনাশক্তির ভিত্তি হয়ে ওঠে।
হুগলি মোহসিন কলেজের একটি ছবি
হুগলি মোহসিন কলেজে তাঁর ছাত্রজীবনের বহু স্মৃতি আজও সযত্নে সংরক্ষিত। কলেজের ওয়েবসাইট এবং প্রশাসনিক ভবনে আজও বঙ্কিমচন্দ্রের ছবি বিশেষ স্থান দখল করে আছে, যেন কলেজটি তাঁর সাহিত্যিক জাগরণের নীরব সাক্ষী।
হুগলি মোহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদ মোহসিন, যিনি তাঁর সম্পদ সমাজ ও শিক্ষার কল্যাণে দান করেছিলেন। ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ ম্যাকলে রিপোর্টের পর গড়ে ওঠা ভারতের প্রথমদিকের আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির একটি। সেই সময়ে যখন উচ্চশিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না, তখন একজন মুসলিম সমাজসেবীর এমন উদ্যোগ ছিল ইতিহাসের দৃষ্টিতে অসামান্য এবং সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যের দৃষ্টান্ত।
আজ ১৮৯ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে এই কলেজ দাঁড়িয়ে আছে, প্রমাণ হিসেবে যে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত। হুগলি মোহসিন কলেজ বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। এর আগে এটি ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল। এখানে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা বিভাগের বিভিন্ন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স পড়ানো হয়। বিজ্ঞান বিভাগে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, ভূতত্ত্ব ও অর্থনীতি পড়ানো হয়; আর কলা ও বাণিজ্য বিভাগে বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন এবং বাণিজ্যের (হিসাবরক্ষণ) পাঠক্রম চালু রয়েছে।
হুগলি মোহসিন কলেজের বর্তমান প্রিন্সিপাল
সম্প্রতি কলেজটি NAAC-এর পক্ষ থেকে B++ গ্রেড পেয়েছে। এটি UGC-র “College with Potential for Excellence” এবং ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি মন্ত্রণালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের “Star College” মর্যাদা অর্জন করেছে। পাশাপাশি DST-FIST প্রকল্পের আওতায় বিজ্ঞান শিক্ষাকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। হুগলি জেলায় হিন্দুদের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যা মুসলিম সম্প্রদায়ের, এবং এই বহুমাত্রিকতা কলেজেও স্পষ্ট। বর্তমানে এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক রয়েছেন, যা প্রমাণ করে যে প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই সকল সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলার একটি সুমিলিত শিক্ষামডেল।
কলেজের প্রিন্সিপাল ড. পুরুষোত্তম প্রামাণিক বলেন, তিনি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মানসম্মত শিক্ষা দিতে চান, এবং তাঁর লক্ষ্য, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রতিটি ছাত্র যেন শুধু জ্ঞানসমৃদ্ধ নয়, দায়িত্ববান বৈশ্বিক নাগরিকও হয়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠান শুধু শিক্ষায় নয়, গবেষণাতেও অগ্রগণ্য। উর্দু, ভূতত্ত্ব এবং ফিজিওলজির মতো কয়েকটি বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র পিএইচডি কেন্দ্র হিসেবেও স্বীকৃত। গবেষণাকে আরও উৎসাহিত করার জন্য একটি বিশেষ রিসার্চ ও সেমিনার সাব-কমিটি কাজ করে, যা গবেষণাপত্র উপস্থাপনা, শিক্ষার্থীদের মাইক্রো-রিসার্চ এবং দেশ-বিদেশের বিদ্বানদের আমন্ত্রিত বক্তৃতার আয়োজন করে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণার উন্নত সুযোগ এবং বৈশ্বিক একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।
হুগলি মোহসিন কলেজের কিছু শিক্ষার্থীরা
হুগলি মোহসিন কলেজ শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি ভারতীয় ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়। এখানে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো এক অসামান্য সাহিত্যপ্রতিভা অধ্যয়ন করেছেন, একজন মুসলিম দাতা শিক্ষা জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন, এবং প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই কলেজ ভারতীয় সমাজকে নতুন চিন্তক, লেখক, বিজ্ঞানী এবং প্রশাসক তৈরি করে আসছে। আজ যখন ‘বন্দে মাতরম্’ এবং ‘আনন্দমঠ’ আবারও আলোচনার কেন্দ্রে, তখন হুগলি মোহসিন কলেজের ঐতিহ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভারতের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত উত্তরাধিকার সবসময়ই বৈচিত্র্য, সমন্বয় এবং যৌথ প্রচেষ্টার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের স্বপ্ন, মোহসিন সাহেবের উদারতা এবং ভারতের যৌথ ঐতিহ্যকে সালাম জানিয়ে এই কলেজ আজও উৎকৃষ্ট শিক্ষার এক দৃঢ় স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।