মাশরুমের চাষের মাধ্যমে অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন মিনা বেগম ও সুফিয়া বেগম

Story by  Munni Begum | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 d ago
মিনা বেগম ও সুফিয়া বেগমের মাশরুমের চাষ
মিনা বেগম ও সুফিয়া বেগমের মাশরুমের চাষ
 মুন্নী বেগম , গুয়াহাটি ঃ

আর্থিক সংকট দূর করতে কৃষিকাজকে উপার্জনের একমাত্র পথ হিসেবে গ্রহণ করে নিজেকে একজন সফল মহিলা কৃষক হিসেবে গড়ে তুলেছেন বাক্সা জেলার বরমার মিনা বেগম। জৈবিক পদ্ধতিতে মাশরুমের  (অয়েস্টার মাশরুম) উৎপাদন করে তিনি কৃষিক্ষেত্রে নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুরুতে তিনি নিজের ঘরের চালার নিচে প্রায় এক কেজি মাশরুমের  রোপণ করে পরে “মিনা মাশরুম ফার্ম” নামে একটি ফার্ম চালু করেন। বর্তমানে তার উৎপাদিত মাশরুম  রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং রাজ্যের বাইরে রপ্তানি হচ্ছে।

মহিলা কৃষক মিনা বেগম 'আওয়াজ-দ্যা ভয়েজ'কে বলেন,"২০১৫ সাল থেকে আমি মাশরুমের  চাষ করছি। ১০ হাজার টাকা দিয়ে এই চাষ শুরু করি। প্রথমে আমার ঘরের চালার নিচে মাত্র ৪০০ গ্রাম মাশরুমের  বীজ লাগিয়েছিলাম, এবং সেখান থেকে ৬ কেজি মাশরুম উৎপাদিত হয়। সেগুলি বিক্রি করে আমি ৬০০ টাকা লাভ করি। এরপর আমি মাশরুমের  সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়িয়ে ২ হাজার পর্যন্ত নিয়ে যাই। কিন্তু বন্যা ও কোভিডের কারণে আমার অনেক সিলিন্ডার নষ্ট হয়ে যায়। তবে আমি হাল না ছেড়ে আবার চাষ শুরু করি। বর্তমানে আমার কাছে ১ হাজার মাশরুমের  সিলিন্ডার রয়েছে।"
 
 
মিনা বেগম ও সুফিয়া বেগম
 
আর্থিকভাবে দুর্বল ‘মিনা মাশরুম ফার্ম’-এর মালিক মিনা বেগম মাশরুমের  চাষ করে তার পরিবার পরিচালনা করে আসছেন। তিনি মাশরুমের  চাষ থেকে বছরে ৫০ হাজার টাকারও বেশি আয় করেন। তিনি শুধু মাশরুমের  চাষই করেন না, বরং মাশরুমের  থেকে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করে রাজ্য তথা রাজ্যের বাইরেও রপ্তানি করছেন।

মিনা বলেন,“মাশরুমের  চাষ একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। এই চাষ করে অনেকেই তাদের পুরো পরিবার চালিয়ে যাচ্ছেন। যখন আমি প্রথম এই চাষ শুরু করি, তখন অনেক লোকসানের মুখে পড়েছিলাম। কারণ, কেউই আমার  থেকে মাশরুম কিনতে আসত না। এর একমাত্র কারণ ছিল, মানুষের মধ্যে এই ভুল ধারণা ছিল যে মাশরুম খেলে মৃত্যু হয়। মাশরুম  মূলত উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যেই বেশি খাওয়ার প্রবণতা আছে। শহরে এর কিছুটা বাজার থাকলেও গ্রামে খুবই খারাপ অবস্থা।

এরপর আমি মাশরুমের  উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানার জন্য কলকাতা গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, মাশরুম  যদি মদ বা মাদকজাত দ্রব্যের সঙ্গে খাওয়া হয়, তবে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। এরপর আমি ফিরে এসে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মাশরুমের  গুণাগুণ ও অপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা গড়তে শুরু করি।”
 
বিপুল পরিমানে মাশরুমের উৎপাদন
 
৫ জন কর্মচারী নিয়ে মাশরুমের  চাষ করে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা মিনা এখন অনেককেই আত্মনির্ভরশীল করে তুলেছেন। তিনি এক হাজারের বেশি নারী ও পুরুষকে বিনামূল্যে মাশরুমের  চাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি ২৫টি মহিলা গোষ্ঠী ও ১০টি পুরুষ গোষ্ঠীকে (প্রতিটি গোষ্ঠীতে ১২ থেকে ৬০ জন সদস্য) বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি অ্যাগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র ও NABARD-এর পক্ষ থেকেও প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন।

মাশরুমের  চাষ সম্পর্কে মিনা বলেন,"মাশরুমের  চাষের জন্য শালিধানের খড়ের প্রয়োজন হয়। খড়গুলো ১-২ ইঞ্চি করে কেটে এক বা দুই দিন জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর সেগুলো চুন ও নিমপাতা দিয়ে সিদ্ধ করতে হয়। সিদ্ধ করার পর খড়গুলো ফ্যানের বাতাসে বা রোদে আধা শুকিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেট করে তাতে মাশরুমের বীজ রোপণ করতে হয়। এই চাষ পুরোপুরি জৈবিক পদ্ধতিতে করা হয়।

 
বিদেশের বাজার দখলের জন্য তৈরী
 
আসামের জলবায়ু অইস্টার মাশরুম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে বাটন মাশরুম চাষের জন্য নয়। বাটন মাশরুম কেবলমাত্র ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়, অর্থাৎ ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে চাষ করা যায়। যদি কেউ শূন্য তাপমাত্রা নিশ্চিত করতে পারে, তবে তারা এটি চাষ করতে পারে।

অইস্টার, মিল্কি, চিকাকাই, ফ্লোরিডা ইত্যাদি মাশরুম সব ঋতুতেই চাষ করা যায়। আমি অইস্টার, মিল্কি ও ফ্লোরিডা – এই তিন ধরনের মাশরুম চাষ করি, যেগুলো রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও দেশের বাইরের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি হয়।

মাশরুমের  পাশাপাশি মীনা বেগম কেঁচো সার, আচার, নারিকল থেকে জাম-জেলী, আইসক্রিম, শরবত, বিস্কুট, চাটনি প্রভৃতি তৈরি করে আসছেন। তাকে 'কোকোনাট বাইদেউ' বলেও অভিহিত করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে কেঁচো সারের উৎপাদন শুরু করা মীনার ৮টি কেঁচো সারের ট্যাঙ্ক রয়েছে, এবং প্রতি ট্যাঙ্ক থেকে ১ কুইণ্টল সারের উৎপাদন হয়। মীনা একা এই কেঁচো  সারের ব্যবসা চালিয়ে প্রতি বছর ৮০-৯০ হাজার টাকা আয় করে আসছেন। তার এই কাজের জন্য তিনি সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃতও হয়েছেন।

অন্যদিকে, এস বি মাশরুম ফার্মের মালকিন সুফিয়া বেগম, আরেকজন মহিলা কৃষক,মাশরুমের   চাষ করে এই ক্ষেত্রেও নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছেন। ২০০৭ সাল থেকে মাশরুমের  চাষ শুরু করা সুফিয়া বলেন, "বর্তমানে মাছ-মাংস, শাক-পাচলি ইত্যাদি সব কিছুতেই কেমিকেল মিশিয়ে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে মাশরুম  হচ্ছে ঔষধি গুণে পূর্ণ এক ধরনের খাদ্য।  এর উৎপাদন প্রক্রিয়া খুবই সহজ। তাই আমি ভাবলাম, যদি বাড়িতে এটি চাষ করা যায়, তাহলে মানুষ জৈবিক পদ্ধতিতে উৎপন্ন ঔষধি গুণসম্পন্ন খাদ্য খেতে পারবে।"

এই মহিলাদের কাহিনী শুধু কৃষি ক্ষেত্রের সফলতা নয়, বরং জৈবিক চাষের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহেরও দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।