বিজ্ঞানী ড. রেমি হুছনেআরা
মুন্নী বেগম , গুয়াহাটি
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকেই সৌন্দর্য চর্চার জন্য প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে অতিরিক্ত ব্যস্ত জীবনে এই উপকরণগুলো সংগ্রহ করা এবং প্রসাধন তৈরি করতে যথেষ্ট অসুবিধা হয়। তাই বর্তমানে বাজারে সহজেই পাওয়া যায় এমন নানা রাসায়নিক সংমিশ্রিত প্রসাধনের ব্যবহার বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রেও একটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিয়েছেন ড. রেমী হুছনেআরা। গুৱাহাটী বাসী ড. রেমী সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে সৌন্দর্য চর্চার সামগ্রী তৈরি করে ব্যবসা শুরু করেছেন।
‘আওয়াজ - দ্যা ভয়েজ’ এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ড. রেমী হুছনেআরা বলেন, "ছোটবেলা থেকেই আমি সৃষ্টিশীল কাজ করতে খুব পছন্দ করতাম। ২০১২ সালে যখন আমি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য গিয়েছিলাম, তখন একদিন আমার রুমমেট জেসিকা স্টিনেন বললেন, 'আজ আমার সাবান শেষ হয়ে গেছে, চল আমি সাবান বানাই।' জেসিকার কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কারণ ছোটবেলা থেকেই আমি কখনও ঘরে সাবান বানানোর কথা শুনিনি। জেসিকা আমাকে বলেছিল, তারা কখনো বাজার থেকে সাবান কিনে ব্যবহার করে না, শুধু ঘরে তৈরি করা সাবান ব্যবহার করে। জেসিকা আমাকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে ঘরে সাবান তৈরি করতে শিখিয়েছিল।"
ভাৰতীয় পরম্পরায় প্রাচীনকালে শরীর পরিষ্কারের জন্য সাবান ব্যবহৃত হতো না। শরীর পরিষ্কারের জন্য গমের গুঁড়ি, বেচন, দুধ, হলুদ, নিম পাতার রস, নিম পাতা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হতো।
বিভিন্ন সাবানের ডিজাইন
ড. রেমী বলেন, "জেসিকার কাছে সাবান তৈরি করার অনেক বই ছিল, যেগুলি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি আগ্রহ সহকারে সেগুলি পড়লাম এবং কিছু সাবানও তৈরি করলাম। কিন্তু তখন পড়াশোনার চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, আমি সাবান তৈরি করার জন্য সময় বের করতে পারছিলাম না। পরে আমি বাড়ি ফিরে আসি। কিছু বছর পর,যখন আমার দুই মেয়ের ত্বকের সমস্যা হয়েছিল, তখন আমি আবার প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে কিছু পরিমাণ সাবান তৈরি করতে শুরু করলাম। পরে আমার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনেরা আমার কাছে সাবান চাইল এবং এভাবেই আমি সাবান তৈরি করতে থাকলাম। এখন আমার সাবান 'Ray Me' ব্র্যান্ডের মাধ্যমে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।"
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ড. রেমী হুছনেআরা একজন জৈব প্রযুক্তিবিদ, অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিফু ক্যাম্পাসের অধ্যাপিকা, উদ্যোক্তা, শিল্পী, চিত্রশিল্পী, এবং একজন মা। এতসব ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সাবান তৈরি করে আসছেন। সাবান তৈরির জন্য ব্যবহৃত উপকরণগুলির মধ্যে রয়েছে বাঁশের কয়লা, অলিভ অয়েল, কেলামাইন মাটি, চন্দন গুঁড়ি, গোল্ড ডাস্ট, মান্দারিন, রোজমেরি, ল্যাভেন্ডার, জেসমিন, ডেড সি সল্ট, হিমালয়ান পিঙ্ক সল্ট, কোকো পাউডার, এবং এরাবিকা কফি। এসব উপাদান তিনি অনলাইনে কিনে থাকেন।ভারতীয় পরম্পরায় প্রাচীনকালে শরীর পরিষ্কারের জন্য সাবান ব্যবহার করা হত না। শরীর পরিষ্কারের জন্য গমের গুঁড়ি, বেসন এবং দুধ, হলুদ, নিমের রস, নিম পাতা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হত।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ডঃ রেমি হুসনেআরা একাধারে একজন জৈবপ্রযুক্তি বিজ্ঞানী, অসম বিশ্ববিদ্যালয় (ডিফু ক্যাম্পাস)-এর অধ্যাপিকা, উদ্যোক্তা, শিল্পী, চিত্রশিল্পী এবং একজন মা। এত ব্যস্ত জীবনের মাঝেও তিনি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের সাবান তৈরি করে আসছেন। সাবান তৈরির জন্য ব্যবহৃত উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাঁশের কয়লা, অলিভ অয়েল, কেলামাইন মাটি, চন্দনের গুঁড়ো, গোল্ড ডাস্ট, ম্যান্ডারিন, রোজমেরি, ল্যাভেন্ডার, জেসমিন, ডেড সি সল্ট, হিমালয়ান পিংক সল্ট, কোকো পাউডার, আরাবিকা কফি ইত্যাদি উপকরণ, যেগুলি ডঃ রেমি অনলাইনের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন।
ডঃ রেমি বলেন, “আমি সাবানে ছাগলের দুধ ছাড়াও বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করি, যেমন নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, অ্যাক্টিভেটেড চারকোল, মুলতানি মাটি, ফ্রেঞ্চ ক্লিন ক্লে, গোলাপ, ল্যাভেন্ডার, লিলি, কমলা, লেবু, স্ট্রবেরি, আপেল, পিচ, আঙুর, চেরি, কিউই, গ্লিসারিন, কেলামাইন মাটি, চন্দনের গুঁড়ো, নিমপাতা, হলুদ, আমলকি, মেঘলা ফুল, ভ্যানিলা, চা গাছ, বাঁশের কয়লা, ইউক্যালিপটাস, লেমনগ্রাস, শিয়া বাটার, কোকো বাটার, ম্যাঙ্গো বাটার, গোল্ড ডাস্ট, ম্যান্ডারিন, রোজমেরি, ল্যাভেন্ডার, জেসমিন, ডেড সি সল্ট, হিমালয়ান পিংক সল্ট, কোকো পাউডার, আরাবিকা কফি, তরমুজ, হোয়াইট টি, অ্যালোভেরা ইত্যাদি উপাদান। ছাগলের দুধ মূলত একটি অ্যাডেটিভ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি অ্যাডেটিভের গুণাগুণ আলাদা।”
পরিবারের সাথে বিজ্ঞানী ড. রেমি হুছনেআরা
ডঃ রেমির এই উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে সাবান তৈরি করে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যা সৌন্দর্যচর্চার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতনতাও গড়ে তোলে।
বর্তমানে সৌন্দর্যচর্চার উপযোগী প্রায় সব উপাদান সহজে প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা কঠিন। কিছু উপাদান বাজারে পাওয়া গেলেও, তা থেকে প্রসাধন তৈরির প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায়, অধিকাংশ মানুষ সহজলভ্য ও সস্তা বাজারজাত প্রসাধনী ব্যবহার করে। কিন্তু এসব প্রসাধনী দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানে মেশানো হয়, যা আমাদের ত্বক ও চুলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমন পরিস্থিতিতে ডঃ রেমি প্যারাবেন ও সালফেট মুক্ত, সম্পূর্ণ জৈবিক এবং FDA স্বীকৃত উপাদান ব্যবহার করে সাবান ও অন্যান্য পণ্য তৈরি করছেন।
ডঃ রেমি বলেন, “সাবান প্রকৃতপক্ষে প্রসাধনী পণ্য নয়। এটি একটি পরিষ্কারের মাধ্যম। সাবান সাধারণত একটি সম্পূর্ণ রাসায়নিক প্রক্রিয়া 'স্যাপনিফিকেশন'-এর মাধ্যমে তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ায় ফ্যাটি অ্যাসিড, তেল এবং ক্ষার (আলকালি)-এর বিক্রিয়ার মাধ্যমে সাবান তৈরি হয়। বাজারে যে সাবান পাওয়া যায়, তা প্রকৃত অর্থে সাবান বলা যায় না, কারণ এতে প্যারাবেন, সালফেটসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় যা ত্বকের নানা রোগের কারণ হতে পারে। আমি যে উপকরণ ব্যবহার করি, সেগুলি অনলাইনে অর্ডার করে আনি। এসব সাবানে ব্যবহৃত অর্গানিক তেল ও কাঁচামাল FDA অনুমোদিত হওয়ায় তা বেশ ব্যয়বহুল হয়। তাই আমার সাবান ও অন্যান্য পণ্যের মূল্য বাজারে সহজলভ্য সাবানের তুলনায় কিছুটা বেশি। বর্তমানে আমার সাবান ‘বিদ্যুৎ এন্ড রাকেশ’-এর ডিজাইনার স্টোরে ডিজাইনার ব্রাইডাল পিস হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে।”
নতুন কিছু তৈরি করতে ভালোবাসেন ডঃ রেমি। তিনি নিজের হাতে ব্লেড ব্যবহার করে নানা ধরনের সাবানের ডিজাইন তৈরি করেন। ফুল, ডেজার্ট, লুফা প্রভৃতি নানান আকারে ও নকশায় তিনি সাবান প্রস্তুত করেন। একটি সাবান তৈরি করতে তাঁর ১০ মিনিট থেকে শুরু করে ২ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
রকমারি নিজের হাতের তৈরী সাবান
ডঃ রেমি বলেন, “সাবান তৈরির জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। একটি সাবান তৈরিতে কত সময় লাগবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে তার ডিজাইনের উপর। কারণ, একটি সাবানের নিখুঁত ডিজাইন পেতে গেলে মাঝে মাঝে আমার একাধিক ব্যাচ নষ্ট হয়ে যায়। কিছু কিছু ডিজাইন আবার আমি নিজ হাতে ব্লেড দিয়ে কেটে তৈরি করি। ফুল, ক্রিস্টাল ইত্যাদি ডিজাইনের সাবানগুলো হাতে কেটে প্রস্তুত করি। এরপর আবার একটি ভিন্ন ফ্রেমে বসিয়ে নতুন করে ডিজাইন কাটতে হয়। এভাবে কোনো একটি সাবান প্রস্তুত করতে কখনো দুই দিন, কখনো ২৪ ঘণ্টা, কখনো ৪ ঘণ্টা বা কখনো মাত্র ১০ মিনিটও সময় লাগে।
আমার সাবানের কিছু ডিজাইনের নাম হলো:The Blooming Swirl (3D Design),Crystal Collection,Mermaid in Crystal Bowl,
Fleu্Coco Berries Dessert Soa্Reem,Twig & Tulle,Blush,Sugar Maple,Allure Woods,Creamy Triple Butter,Shea Bar, Cocoa Bar
Cuddle,Transparent Glycerine Soap,Crystal Clear Glycerine,Ultra Clear Transparent Soap ইত্যাদি।”
ডঃ রেমির সাবানের আরেকটি বিশেষত্ব হলো এর সুগন্ধ। এই সুগন্ধ তিনি নিজেই তৈরি করে সাবানে ব্যবহার করেন।এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার সাবানের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে এর সুগন্ধ। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নানা ধরনের সাবান পাওয়া যায় এবং প্রতিটি সাবানের গন্ধ আলাদা। এই গন্ধ দীর্ঘস্থায়ী করতে নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা আমাদের ত্বকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। এমন সাবান ব্যবহারে ত্বকের নানা রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তাই আমি আমার সাবানে নিজেই তৈরি করা সুগন্ধ ব্যবহার করি, যা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত এবং ত্বকের কোনো ধরনের ক্ষতি করে না।
ডঃ রেমি শুধু সাবান নয়, আরও অনেক প্রাকৃতিক পণ্য তৈরি করেছেন—যেমন লিপ বাম, বাথ সল্ট, হেয়ার অয়েল এবং লোশন, যেগুলির জন্য তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে ভাল সাড়া পেয়েছেন। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি তার হেয়ার অয়েল চুলের নানা সমস্যা দূর করতে সহায়ক।
ড. রেমি হুছনেআরা পরীক্ষা- নিরীক্ষায় রয়েছেন
ডঃ রেমি তাঁর পণ্যসমূহ ইনস্টাগ্রামে [rayme natural fatis] এবং ফেসবুকে [rayme_artnsoaps] অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেন।
সাবান তৈরির পাশাপাশি, ডঃ রেমি বিভিন্ন ধরনের পেইন্টিং এবং ডিজাইনার পোশাকও তৈরি করে থাকেন। তিনি বলেন, “আমি মাঝে মাঝে ওয়াটার কালার, অয়েল পেইন্টিং এবং মিক্সড মিডিয়া আর্ট করি। সম্প্রতি রেজিন আর্টও শুরু করেছি। স্কুলে পড়ার সময় আর্ট করে অনেক পুরস্কার পেয়েছিলাম। বর্তমানে আমি বাড়ির ইন্টিরিয়র অনুযায়ী প্রিন্টিং তৈরি করি। এখন আমি শুধুমাত্র নিজের জন্য বা কেউ অর্ডার দিলে চিত্রাঙ্কন করি। আমার পেইন্টিংয়ে আমি সব ধরনের মিডিয়া ব্যবহার করি।”উল্লেখযোগ্যভাবে, ডঃ রেমি সালমোনেলোসিস-এর জন্য একটি ভ্যাকসিনও তৈরি করেছেন।
প্রকৃতিপ্রেমী ডঃ রেমি তাঁর নিজ বাসভবনে ছোট আকারে একটি বাগান গড়ে তুলেছেন, যেখানে অনেক বিরল ও দুর্লভ গাছের সংগ্রহ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে ডঃ রেমি বলেন,
“বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা সংগ্রহ করার একটি শখ আমার বহুদিনের। আমি বহু বিরল ও দুষ্প্রাপ্য গাছের চারা সংগ্রহ করেছি—যেগুলি সহজে পাওয়া যায় না এবং যেগুলির দামও অনেক বেশি। আমি এই চারাগুলি অনলাইনে ক্রয় করি। বর্তমানে আমার সংগ্রহে বিরল প্রজাতির ফিলোডেনড্রন, এনথুরিয়াম, সিঙ্গোনিয়াম, অ্যালোকেশিয়া সহ ৭০টিরও বেশি প্রজাতির গাছ রয়েছে, এবং আমি এই সংখ্যা ১৫০তে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছি। আমি ভবিষ্যতে এই সংগ্রহকে কেন্দ্র করে একটি ছোট ব্যবসা শুরু করতেও ভাবছি।”
মহিলাদের উদ্দেশ্যে ডঃ রেমির বার্তা:“নারীরা যেন আত্মবিশ্বাসী হয়। কারণ অনেক সময় দেখা যায় যে, সমাজ বা পরিবারের কাছ থেকে তারা প্রয়োজনীয় সমর্থন পায় না বলেই তারা এগিয়ে যেতে পারে না। অনেক মহিলা রয়েছেন যাঁরা বহু প্রতিভার অধিকারী, কিন্তু সমর্থন ও সহযোগিতার অভাবে তাঁদের প্রতিভা প্রকাশ পায় না। এই ক্ষেত্রে আমাদের উচিত তাঁদের পাশে দাঁড়ানো ও আত্মবিশ্বাস জোগানো।”