অসমের রানী হাজরিকা এখন ভারতের বিভিন্ন ভাষায় গানের জন্য পরিচিত কণ্ঠশিল্পী

Story by  Daulat Rahman | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 d ago
 কণ্ঠশিল্পী রানী হাজরিকা
কণ্ঠশিল্পী রানী হাজরিকা
 
দৌলত রহমান , গুয়াহাটি ঃ

মুসলিম পরিবারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করার কারণে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তারপরও অসমের রানী হাজরিকা মাত্র ৩ বছর বয়সে গান গাওয়া শুরু করেছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া অবস্থায় তিনি পেশাদারভাবে গান গাওয়া শুরু করেন। অষ্টম শ্রেণী পাস করার সময়েই তিনি অসমীয়া সংগীত জগতের মধ্যে একটি জনপ্রিয় নাম হয়ে উঠেছিলেন।

তারপর থেকে রানী আর পিছনে ফিরে তাকাননি এবং আজ পর্যন্ত তিনি বলিউডের পাশাপাশি বাংলা, অসমীয়া, মৈথিলী, উড়িয়া, কানাড়া, মালয়ালম, তেলেগু, এবং কাশ্মীরি সিনেমায় অসংখ্য গান গেয়েছেন। প্রতিভাবান এই কণ্ঠশিল্পী আজ পর্যন্ত অনেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ২০১৮ সালে Best Versatile Singer হিসেবে প্রাপ্ত সম্মানীয় দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।

‘আওয়াজ দ্য ভয়েস’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রানী হাজরিকা তার সংগীতের প্রতি আগ্রহ, তার কর্মজীবন, তার প্রেরণা, তার সংগ্রাম এবং তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানান।
 
রানী হাজরিকা স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং করার মুহূর্তে
 
 
 
 
 
‘আমি একটি সংগীত পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলাম। আমার বাবা প্রয়াত রোজ হাজরিকাও ছিলেন একজন গায়ক। তিনি তথ্য এবং সম্প্রচার বিভাগের গান ও নাটক বিভাগে শিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তাই সংগীত আমার রক্তে রয়েছে, এবং এই পৃথিবীতে প্রথম চোখ মেলানোর পর থেকেই সংগীতের সঙ্গে আমি যুক্ত। সংগীত আমার মধ্যে সবসময় রয়েছে,’ রানী হাজরিকা বলেন।

 উল্লেখযোগ্য যে, রানী হাজরিকা উত্তর প্রদেশের লখনৌর প্রতিষ্ঠিত ভাটখাণ্ডে মিউজিক ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটি থেকে 'ভোকাল' শাখায় সংগীতের স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। অসমের যোগ্য কণ্ঠশিল্পীর সংগীত গুরু সন্তোষ পণ্ডিত এবং বলিউডের প্লেব্যাক গায়ক জসপিন্দর নারুলার নির্দেশনায় পেশাদার সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।

যখন রানী মুম্বাইতে উপস্থিত হন, তখন সেখানে তার কোনো পরিচিতি ছিল না; মুম্বাইয়ে তার কোনো গডফাদারও ছিল না। কিছু ভাল বন্ধু ছাড়া সেখানে তার কোনো পরিচিতি ছিল না। তিন মাস ধরে তিনি শুধুমাত্র ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার আশায় সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। গানগুলোর সিডি বিভিন্ন মিউজিক্যাল কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়েছিল। এরপর হঠাৎ একদিন তিনি একটি মিউজিক্যাল কোম্পানির থেকে ফোন পান। তারা বলেছিল, তার কণ্ঠটি খুব সুন্দর এবং তারা রানীর সাথে সঙ্গে দেখা করতে চায়।
 
‘কোম্পানিটি আমাকে কিছু শো করার প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু সৎ কথা বলতে গেলে আমার তাতে কোনো আগ্রহ ছিল না। ইতিমধ্যে আমি অসমে অনেক শো করেছিলাম এবং শুধুমাত্র টাকা উপার্জন করার জন্য শো করতে মুম্বাইকে আমার জীবনের পরবর্তী গন্তব্যস্থল হিসেবে বেছে নেননি। আমি আমার কষ্টোপার্জিত অর্থের একটি ভাল পরিমাণ নিয়ে মুম্বাইয়ে ছিলাম এবং সে কারণে টাকার অভাবে সমস্যায় পড়িনি। প্লেব্যাক সিঙ্গার হওয়ার জন্যই আমি মুম্বাই এসেছিলাম। আমি জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো 'ইন্ডিয়ান আইডল' এর জন্য অডিশন দিয়েছিলাম এবং আমি অনুষ্ঠানের শীর্ষ ৩০ এর মধ্যে স্থান পেয়েছিলাম। এরপর আমি Jab We Met সিনেমায় গান গাওয়ার সুযোগ পাই। ছবিতে আমি প্লেব্যাক ভয়েজ বেকিং কণ্ঠশিল্পী ছিলাম। জনপ্রিয় অভিনেত্রী কারিনা কাপুর খান ছবির মুখ্য অভিনেত্রী ছিলেন এবং এই সিনেমার মাধ্যমে আমি বলিউডে যাত্রা শুরু করি। এরপর টলিউডসহ বিভিন্ন উদ্যোগ থেকে আমি বহু প্রস্তাব পেয়েছিলাম,’ রানী হাজরিকা বলেন।
 
 প্রখ্যাত শিল্পী রাণী হাজারিকা
 
চলচিত্রে গান গাওয়ার পাশাপাশি রানী হাজরিকা রিয়েলিটি শো এবং সিঙ্গিং প্রতিযোগিতাতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সংগীত অনুষ্ঠান সারেগামাপা, সিঙ্গিং সুপারস্টার, ভয়েস অফ ইন্ডিয়া মুম্বাই, বল্লিউড ক্লাব অফ জম টিভি, রক দ্য ধুন ইত্যাদি বহু প্রতিযোগিতায় তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে ভয়েস অফ ইন্ডিয়া তে তিনি ছিলেন অন্যতম ফাইনালিস্ট। ২০১০ সালে সারেগামাপা তেও তিনি মেগা ফাইনালিস্ট ছিলেন।

রাণী হাজরিকা বলিউডের সিনেমা Choo le Aasmaan, EK – The Power of One, Memsaab, Yeh Kaisa Karz Hai, Kranti – The Revolutionary, Shudra – The Rising এর প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি অসমীয়া, ছত্তীশগড়ী, ভোজপুরী, তেলেগু, মালয়ালম, মৈথিলী মতো বহু আঞ্চলিক সিনেমাতেও প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। টিভি বিজ্ঞাপন এবং টাইটেল ট্র্যাকেও তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন।

একটি প্রশ্নের উত্তরে  তিনি আঞ্চলিক ভাষায় গান গাওয়া তার জন্য কতটা কঠিন ছিল, রানী হাজরিকা বলেন, "নিশ্চয়ই কঠিন। তবে, আমি কাশ্মীরী ভাষায় গান গাওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি কঠিন পেয়েছিলাম। তবে,একজন শিল্পী হিসেবে আমাদের প্রতিটি ভাষা জানা উচিত এবং সেই ভাষায় গান গাওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। কারণ সংগীতের কোনো ভাষা নেই। সংগীত মানুষের আত্মার সঙ্গে যুক্ত এবং সংগীতের সাধনা মানুষকে যেকোনো ভাষা আয়ত্ত করার ক্ষমতা প্রদান করে।"
 
কাশ্মীরের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী জাননিছার লনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া রানী হাজরিকা ‘ওয়াজওয়ান’-এর প্রতি তার আকর্ষণ প্রকাশ করে “সালাম ই ওয়াজওয়ানে” নামক কাশ্মীরী হিট গানটি গেয়েছেন। ওয়াজওয়ান শুধুমাত্র একটি জনপ্রিয় খাবারই নয়, এটি কাশ্মীর এবং কাশ্মীরী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেও তিনি জানিয়েছেন। তার অন্যান্য কাশ্মীরী গানের মধ্যে "MaenziRaath", "KatyuChukhNundbaane" ইত্যাদি রয়েছে।
 

আবির খেলার আনন্দে মাতওয়ারা রানী
 
"কাশ্মীরী যুবক-যুবতীদের সংগীত জগতের মধ্যে প্রবেশ করতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে আমি এখন একটি মিউজিক চ্যানেল পরিচালনা করছি। বিশেষ করে আমরা প্রতিভাবান কাশ্মীরী যুবতীদের সংগীতের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার শুরু করতে উৎসাহিত করছি। আমাদের চ্যানেলের সাথে প্রথম কাজ করা অনেক যুবতী এখন বলিউডের সংগীত জগতে দারুণ কাজ করছে।"- রানী হাজরিকা বলেন।

এছাড়াও, বর্তমানে রানী হাজরিকা বলিউডে সংগীতকার এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। তার আরো অনেক প্রজেক্ট শীঘ্রই সংগীতপ্রেমীরা দেখতে পাবেন। দুবাইতে তিনি এক সংগীত প্রজেক্টে  নিয়ে কাজ করেছেন। ব্যস্ত কর্মসূচী এবং পেশাদার জীবনের মধ্যেও রানী তার জন্মভূমি অসমের কলা-সংস্কৃতির প্রতি তার দায়িত্ব ভুলে যাননি। যখনই সুযোগ পান, রানী ভারতীয় বিভিন্ন প্রান্তের পাশাপাশি বিদেশে অসমীয়া সংগীত এবং সংস্কৃতির প্রচারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।