মুন্নী বেগম / গুয়াহাটি
আজ অসমীয়াদের হৃদয় বিদারক এক শূন্যতা নিয়ে বিলীন হচ্ছে সকলের প্রিয় শিল্পী জুবিন গার্গ। এক অমোঘ বেদনা যেন অসমবাসীর অন্তরকে ভেঙে দিয়েছে। চারিদিক নীরবতা ছড়িয়ে পড়েছে। অসমীয়া সংস্কৃতির হৃদস্পন্দন, জনপ্রিয় গায়ক, শিল্পী এবং সমাজকর্মী জুবিন গার্গের মৃত্যু রাজ্যে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। আজ অসমবাসী তাদের হৃদয়ের প্রিয় শিল্পীকে অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় দেবার বেলা।
আজকের দিন অসমের সঙ্গীত জগৎ যেন এক গভীর শূন্যতায় ডুবে গেছে। সেই মঞ্চে যেখানে লাখ লাখ শ্রোতা চিৎকার করত, সেই মাইকফোন থেকে উচ্চারিত হত এক অমর কণ্ঠের সুর,আজ সেই মঞ্চ,সেই মাইকফোন নিঃসঙ্গ ও নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ,জুবিন গার্গ নামের সঙ্গীতের যাদুকর তাঁর সঙ্গীত যাত্রার সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন, যার কারণে তাঁর গানের সৃষ্ট স্মৃতি এবং অনুভূতির ঢেউ অসমকে এক অবর্ণনীয় বেদনার সাগরে ঢেলে দিয়েছে।
জুবিন গাৰ্গের এক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের দৃশ্য
প্রেম, বিদ্রোহ, আশা, হাসি, কান্না—সব ধরনের আবেগে পূর্ণ ছিল জুবিনের গান। একজন প্রেমিক নিজের প্রেমিকাকে সম্বোধন করতে জুবিনের গান ব্যবহার করেছিল,একজন যুবক বিদ্রোহ প্রকাশ করতে তাঁর গান গেয়েছিল,একজন মা নিজের শিশুকে শোনাতে তাঁর শিশুজীবনের গান শুনিয়েছিল। কিন্তু আজ থেকে সেই গান শুনলে হয়তো সবার হৃদয় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে,খুঁজে ফিরবে কোথায় সেই কণ্ঠ? কোথায় সেই হাসি? কোথায় সেই রক্তাক্ত উল্লাস? শেষ পর্যন্ত একটাই উত্তর মিলবে—আজ তিনি আর নেই।
জুবিনের কণ্ঠ শুধুমাত্র কানেই বাজত না,হৃদয়ের গভীরে তা বাজছিল। এক শিশু থেকে এক বৃদ্ধের আশা পর্যন্ত, সব অনুভূতি তাঁর সঙ্গীতের ঢেউয়ে মিলিত হত। আজও তাঁর গান শুনলেই, ছেলে-মেয়ে, শ্রমিকের শক্তি, শহরের যুবকদের উদ্দীপনা, গ্রামের মানুষের ভক্তি—সবাই হৃদয়ে আবেগে ভরে ওঠে। তিনি সব সময় সবাইকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন, আর আজ সেই হৃদয়ই তাঁকে শেষ বিদায় দেওয়ার শক্তি তুলে ধরেছে।
জুবিন গার্গের অসমের বন্যাক্রান্ত লোকজনের জন্য তহবিল সংগ্রহের দৃশ্য
জুবিনের সংগীত সীমাবদ্ধ ছিল না। নামঘর,মসজিদ,গির্জা আদি সব জায়গায় তার সুর একতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। আজকের দিনে অসম তাকে হারিয়েছে,কিন্তু তার গানই মানুষকে একত্রিত করে রেখেছে। জুবিনের কবিতাময় কণ্ঠ যেন পঞ্চভূতের সঙ্গে একাত্ম। ভূমি,জল,বায়ু,অগ্নি এবং আকাশ—সবখানে তার সুর,প্রতিটি গান সবারই প্রাণে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি শারীরিকভাবে না থাকলেও,এই অমরকণ্ঠ অসমের মানুষের হৃদয়ে সর্বদা অমর হয়ে থাকবেন।
জুবিন গার্গের অন্যতম স্বপ্ন ছিল অসমীয়া চলচ্চিত্রকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যাওয়া। তিনি নিজের সিনেমায় কখনও অভিনয় করেছেন,কখনও সংগীত দিয়েছেন,আবার কখনও নতুন প্রতিভাদের মঞ্চে উঠতে সাহায্য করেছেন। তার স্বপ্ন ছিল অসমীয়া সংগীতকে বৈশ্বিক সুরের সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করা। তিনি ভূপেন হাজরিকার পথ ধরে নিজের বৈশিষ্ট্যে অসমের ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে মিলিয়ে একটি বিশ্বমানের সুরের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আজ তার সেই স্বপ্নগুলো অধরা থেকে গেল।
জুবিন গাৰ্গ তাঁর গানের স্টুডিওতে
জুবিন শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না,তিনি আসলে সমাজের জীবন্ত স্তম্ভ,জনগণের প্রিয় বন্ধু। তাঁর গান চা শ্রমিকের হাতকে আশা দিয়েছিল,জেলেদের সাহস যুগিয়েছিল এবং শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ সেই গান নীরব। একজন সমাজকর্মী হিসেবেও তিনি দুঃখী ও দরিদ্রের পাশে দৌড়ে গিয়ে তাদের সাহায্য করেছেন। জনগণের প্রতি তাঁর অসীম ভালোবাসা আজ অসমবাসীর অশ্রুধারায় প্রতিফলিত হয়েছে। শহর,নগর,গ্রাম—সব জায়গায় আজ তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। যেখানে তিনি হাসি ও সঙ্গীত নিয়ে এগিয়ে চলতেন,সেই পথ আজ নীরব ও স্তব্ধ। প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি শহর,পশু-পাখি,পাখি- সকলই যেন তাদের প্রিয়জনকে হারানোর বেদনায় নিঃশব্দে শোক পালন করছে। সবার মনে একই অনুভূতি — আজ অসম এক সন্তানহীন রাজ্য।
জুবিন গার্গ এই নামটাই যেন অসমের মানুষের হৃদয়ে একটি পৃথিবী। তিনি কেবল একজন সংগীতজ্ঞ,অভিনেতা বা শিল্পী ছিলেন না,তিনি ছিলেন এক অনুভূতি,এক প্রবাহ,এক চেতনা। জুবিন ছিলেন স্বাধীন ও একাকী ব্যক্তি। জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে তিনি তার নিজের বিশ্বাসের ওপরই ভরসা করতেন। অনেক সময় সমাজের নিয়ম, ধারণা বা বাঁধনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া শিল্পীদের মধ্যে জুবিন ছিলেন এক ব্যতিক্রম। তিনি সর্বদা নিজের অবস্থানে দৃঢ় থাকতে জানতেন।
পুষ্পসজ্জিত বাহনে জুবিন গাৰ্গের নিথর দেহ বরঝার বিমানবন্দর থেকে আনার সময় লক্ষ লক্ষ ভক্তের ভিড়
জুবিনের জীবন ছিল মুক্তির গান। তিনি যে গান গেয়েছিলেন,সেগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র সুরের মাধুর্য ছিল না,ছিল এক গভীর বার্তা। প্রেমের কথা,মানবতার কথা,মিলনের কথা নিয়ে গাওয়া তাঁর গানে সবাইর মন স্পর্শ করেছিল। একজন কৃষকের ঘরেও তাঁর গান বাজতো,তেমনি একজন শহুরে শিক্ষার্থীর কানে বাজতো। কারণ জুবিন সবাইয়ের হৃদয়কে একত্র করে রেখেছিলেন। জুবিনের নিজের ব্যক্তিত্বই তা সম্ভব করেছিল। তিনি পদপথে দোকানে বসে রুটি-চা খেতেন,কৃষকের কাছে গিয়ে তাঁর দুঃখ-কষ্ট শোনতেন। তিনি ধনী,গরীব,শহুরে,গ্রামের মানুষ বলে ভেদাভেদ করতেন না। সেই মহান শিল্পী আজ আমাদের মাঝে নেই। তাঁর মৃত্যুর খবর শুধু একজন গায়ক বা অভিনেতার মৃত্যু নয়, এটি যেন অসমের আত্মার এক অংশ ভেঙে পড়ার মতো।
অসম আজ তার একজন জীবন্ত ইতিহাস হারিয়েছে। তবে আসামের প্রতিটি হৃদয়ে, প্রতিটি সংগীতে, প্রতিটি সুরে জুবিন চিরজীবী থাকবে। মানুষ মারা যায়, কিন্তু সুর কখনো মরে না। জুবিন গার্গ হয়তো শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার গান, সুর, স্বপ্ন এবং তিনি দেখানো ঐক্যের পথ আমাদের মাঝে চিরকাল অক্ষয় থাকবে। তার বেদনায় ভাসমান আসামবাসীর নিরব অশ্রু হয়তো কখনো শুকাবে না, সেই অশ্রুর মধ্যেই চিরকাল জীবিত থাকবে আমাদের সকলের হৃদয়ের টুকরো ‘জুবিন গার্গ’। ড° অমরজ্যোতি চৌধুরীর কবিতার মতো “জুবিন এক টুকরো আগুন...যে আগুন কখনো নিভে না...কোথাও নিভে না...জুবিন এক টুকরো আগুন।”