কলকাতা ,
যখন সারা বিশ্বে সম্প্রদায়ভিত্তিক সংঘর্ষ ও যুদ্ধ ক্রমেই বেড়ে চলেছে,তখন এই আন্তঃধর্ম পরিবর্তনকর্তা ভারতের আগামী প্রজন্মের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বীজ বপন করছেন।কলকাতার ওয়াইস আসলাম,যিনি নিজেও একটি বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন, নীরবে কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে আন্তঃধর্ম সংলাপ ও সমঝোতার সেতু নির্মাণে।ইন্ডিয়া প্লুরালিজম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা যুব সমাজ ও নারীদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় বোঝাপড়া ও সহনশীলতা গড়ে তোলার কাজ করে চলেছেন।
আসলাম বলেন,“সংলাপের শক্তির ওপর আমার অটুট বিশ্বাস আছে এবং আমার একমাত্র হাতিয়ার হলো সহমর্মিতা ও শিক্ষা। আমার পরিবারের ধর্মীয় শিকড় অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় — আমার ঠাকুমা ছিলেন ইহুদি, দাদু মুসলিম, আর মায়ের দাদামশায় ছিলেন খ্রিস্টান। আমি আমার নিজের বাড়িতেই ধর্মীয় সম্প্রীতির সহাবস্থান দেখেছি, আর সেখান থেকেই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি এই কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে।”তাঁর জাতীয় নেতৃত্ব বিকাশমূলক কর্মসূচিগুলি পারস্পরিক সম্মান ও অহিংস যোগাযোগের মূল্যবোধকে অন্বেষণ করতে সাহায্য করে।
বিভিন্ন ধর্মের লোকেদের নিয়ে একই মঞ্চে আলোচনা
“নো মাই রিলিজিয়ন” (Know My Religion) নামে একটি উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো হয় হিন্দু, ইসলাম, ইহুদি, খ্রিস্টান, জৈন এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সরাসরি সেই ধর্মের অনুশীলনকারী ও পণ্ডিতদের কাছ থেকে জানার জন্য—এবং সেই সঙ্গে ধর্মীয় কুসংস্কার ও প্রচলিত ভুল ধারণা ভাঙার সুযোগ তৈরি হয়।উপাসনালয় এবং ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলির ধর্মীয় নেতাদের জন্যও সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মশালা আয়োজিত হয়।
“সালাম শালোম” কর্মশালা, একটি ইহুদি-মুসলিম আন্তঃধর্মীয় সংলাপের প্ল্যাটফর্ম, নিয়মিতভাবে আয়োজিত হয় যাতে এন্টিসেমিটিজম (ইহুদিবিদ্বেষ) ও অ্যান্টিমুসলিম প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়া যায়।গত বছর, আসলাম কলকাতার একটি সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়) পরিদর্শন করেন আন্তঃধর্মীয় গঠনমূলক সংলাপ শুরু করার উদ্দেশ্যে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি প্রতীকী প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গাছ রোপণ করেন — যা আশার, বিকাশের ও যৌথ দায়িত্বের প্রতীক।
বর্তমান গাজা ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে মত প্রকাশ করে আসলাম বলেন যে মানবজীবনের প্রতি সম্মান থাকা উচিত এবং সকলে স্বেচ্ছায় সহাবস্থানের মনোভাব নিয়ে চলা উচিত।তিনি বলেন,“ধর্মের নামে এত মেরুকরণ ও রক্তপাত দেখে সত্যিই দুঃখ হয়। জীবন রক্ষা করার চিরন্তন জ্ঞান ইহুদি ও ইসলামী—এই দুই ধর্মের মধ্যেই কেন্দ্রীয় নীতির মতো বিদ্যমান।
পবিত্র কোরআন (সূরা মায়েদা ৫:৩২)-এ বলা হয়েছে:‘...যদি কেউ কোনো একটি প্রাণ রক্ষা করে, তবে সে যেন পুরো মানবজাতির প্রাণ বাঁচাল।’তালমুদ (সানহেদ্রিন ৩৭ এ)-তে বলা হয়েছে:‘...যে একটি জীবন রক্ষা করে, সে যেন গোটা পৃথিবীকে রক্ষা করল।’আমরা সবাই নবী ইব্রাহিম (আঃ)-এর সন্তান। ইহুদি ও মুসলিম—এই দুই সম্প্রদায়ের উচিত করুণা ও ন্যায়বিচারের মূল বার্তাকে হৃদয়ঙ্গম করা ও তা পালন করা।”
শান্তির খোঁজে আসলামের যাত্রা
চায়ের দোকান থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষ পর্যন্ত—যেখানেই হোক, ওয়াইস আসলামের হাতে থাকে শান্তি নির্মাণের কৌশল।তাঁর প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশন স্কুল ও কলেজে শান্তিচর্চা কর্মশালা আয়োজন করেন, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক আরও গভীর হয় এবং একটি পারস্পরিক সংযুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে।‘আন্তঃধর্মীয় আড্ডা’ ও স্থানীয় স্তরে পারস্পরিক সম্মান তৈরির কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি সমাজের শিকড় পর্যন্ত শান্তি ও সহনশীলতার বীজ বপন করছেন।
কলকাতার রাস্তাঘাট থেকেই উঠে আসে মূল্যবান প্রজ্ঞা — এমন এক জগতে, যেখানে রাজনীতিবিদরা মন্দির-মসজিদ নিয়ে বিতর্কে ব্যস্ত, সেখানে ‘আড্ডা’ বা কথোপকথনের এক অন্যরকম রূপ দেখা যায়।আসলাম বলেন,“কলকাতায় আন্তঃধর্মীয় প্রকৃত সংলাপটা হয় চায়ের দোকান কিংবা চানার ঠেলার পাশেই। ‘ইন্টারফেইথ আড্ডা: মিরচি, মাসালা অ্যান্ড মিউচুয়াল রেসপেক্ট’-এর মতো সৃজনশীল উদ্যোগগুলো শহরের রাস্তার দোকানদারদের মুখে-মুখে ঘুরে বেড়ানো সংলাপগুলোকে তুলে ধরে — যেখানে খাবার,ধর্ম ও বন্ধুত্ব খুব স্বাভাবিকভাবে মিলেমিশে যায়, যা প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক পরিবেশে প্রায় অসম্ভব।”
সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রচেষ্টার এক দৃশ্য
নারী নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে শান্তির পথপ্রদর্শন
“শান্তি সালাম” হলো এক অনন্য উদ্যোগ, যা হিন্দু ও মুসলিম তরুণ-তরুণী, নারী ও ধর্মীয় নেতাদের একত্র করে, যেন তারা সহিষ্ণুতা থেকে সক্রিয় সহাবস্থানে পৌঁছাতে পারে—এই লক্ষ্যেই একসাথে খোঁজে নেয় পারস্পরিক মূল্যবোধ ও মিল।এই ফাউন্ডেশন নারীদের ক্ষমতায়ন করে, যাতে তারা স্থানীয় স্তরে আন্তঃধর্মীয় উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং সংলাপ ও দ্বন্দ্ব নিরসনের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে।প্রতিষ্ঠাতা আসলাম মনে করেন:“ভারতে আন্তঃধর্মীয় কাজ নারীদের নেতৃত্ব ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে না—বিশেষ করে সমাজের মূল স্তরে।”
ভজন, বিসমিল্লাহ ও ভ্রাতৃত্ব: ভাগাভাগি আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে ঐক্যের উৎসব
ওয়াইস আসলাম আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির একটি হৃদয়স্পর্শী উদাহরণ তুলে ধরেন, যেখানে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় নেতা একত্রিত হয়েছিলেন কলকাতার শ্রী সত্য সাই সেবা কেন্দ্রে, ঐক্য ও সেবার বার্তা উদযাপন করতে।তিনি বলেন,“এই সমাবেশ ভারতের বহুত্ববাদী চেতনার এক জীবন্ত প্রমাণ — যেখানে বিভিন্ন ধর্ম একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয় মানবতার মাধ্যমে। অনুষ্ঠানে ভজন ও কোরআন তিলাওয়াতের সুর মিলেমিশে এক গভীর পারস্পরিক সম্মানের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।”
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও আসলামের বৈশ্বিক যাত্রা
ওয়াইস আসলাম আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক নিয়ে নিজের দক্ষতা ও জ্ঞান আরও গভীর করতে বহু আন্তর্জাতিক কোর্সে অংশ নিয়েছেন। তিনি ক্যামব্রিজ-এর উলফ ইনস্টিটিউট, KAICIID, অক্সফোর্ড ইন্টারফেইথ, এবং ইউনিভার্সিটি ফর পিস-এ বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
ইন্ডিয়া প্লুরালিজম ফাউন্ডেশন ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশন ও রুবারু (Rubaroo)-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বে বার্ষিক আন্তঃধর্মীয় যুব নেতৃত্ব কর্মসূচি (Annual Interfaith Youth Leadership Programme) পরিচালনা করে, যেখানে প্রতি বছর ১০০-র বেশি তরুণ পরিবর্তনকারী (changemakers) প্রশিক্ষণ পান।
এই প্রশিক্ষণে আন্তঃধর্মীয় শিক্ষা ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs)-এর সমন্বয়ে কমিউনিটি-কেন্দ্রিক সামাজিক প্রকল্প নির্মাণ শেখানো হয়।
প্রতিষ্ঠাতা আসলামের লক্ষ্য এই মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া—যেখানে ধর্ম বিভেদের নয়, বরং সংযোগের শক্তিতে পরিণত হয়।
যোগ্যতার বিবরণ ;
ওয়াইস আসলাম আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা বিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক কোর্সে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর প্রশিক্ষণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:উলফ ইনস্টিটিউট, কেমব্রিজ — ইহুদি-মুসলিম আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক,আন্তর্জাতিক জৈন স্কুল — জৈন ধর্মে প্রশিক্ষণ,অক্সফোর্ড ইন্টারফেইথ — ধর্মে শব্দ ও সঙ্গীত বিষয়ক কোর্স ,ইউফ্রেটিস ইনস্টিটিউট — পিস প্র্যাকটিস অ্যালায়েন্স ও KAICIID — সংলাপ পরিচালনার প্রশিক্ষণ ছাড়াও ইউনিভার্সিটি ফর পিস — গ্লোবাল লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম
ইন্ডিয়া প্লুরালিজম ফাউন্ডেশনের প্রধান উদ্যোগসমূহ
ধর্মকে জানো:
তরুণদের জন্য আন্তঃধর্মীয় শিক্ষা ও ওয়ার্কশপ
শান্তি সালাম গ্রামীণ পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম সংলাপ ও সম্প্রীতির উদ্যোগ।সালাম শালোম :ইহুদি-মুসলিম সংলাপ সিরিজ, যা এন্টিসেমিটিজম ও অ্যান্টিমুসলিম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কাজ করে বার্ষিক আন্তঃধর্মীয় যুব নেতৃত্ব কর্মসূচি:ভারতজুড়ে শান্তি নির্মাতাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে ।
ইন্টারফেইথ আড্ডা :রাস্তাঘাটের আড্ডায় বিশ্বাস,ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের নিদর্শন ।