ইমতিয়াজ আহমেদ,গুয়াহাটি ঃ
একটি প্রচলিত কথা রয়েছে “অভাবই আবিষ্কারের মূল।” এই কথাটি অসমের প্রতিষ্ঠিত ম্যারাথন দৌড়বিদ আব্দুল বারেকের ক্ষেত্রে একেবারে যথাযথ প্রযোজ্য। মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র নদ তাঁর পরিবারের সব চাষযোগ্য জমি গিলে নেওয়ার পর, দিশেহারা হয়ে পড়া পরিবারটির জীবনধারণের জন্য এক সময়ে তাঁকে কঠিন জীবন সংগ্রামে নামতে হয়েছিল। জীবনের শুরুর সময়ে যে আর্থিক সংকটের মুখোমুখি তিনি হয়েছিলেন, তার কারণেই আব্দুল বারেক ম্যারাথন দৌড়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
"আমি কামরূপ জেলার একটি অন্দরমহলের গ্রামে জন্মগ্রহণ করি এবং সেখানেই বড় হয়ে উঠি। ছোটবেলায় কোনো নির্দিষ্ট খেলাধুলার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। যখন ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙনে আমাদের চাষের জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়, তখন আমাদের জীবিকা নির্বাহের আর কোনো উপায় ছিল না। আমাদের গৃহপালিত পশু থেকে সামান্য যা আয় হতো, তা পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ছিলাম। সেই সময় আমাদের পাশের এক গ্রামে রঙালী বিহুর উপলক্ষে আয়োজিত একটি ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিই এবং প্রথম স্থান অর্জন করি। পুরস্কার হিসেবে নগদ ১০০০ টাকা পাই। আমার কাছে সেটা অনেক বড় অঙ্কের টাকা ছিল। সেই টাকায় আমি স্কুলের ইউনিফর্ম ও বই কিনি। এভাবেই আমি উপার্জনের একটি পথ খুঁজে পাই।"
"সেই সময়ে আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তাই, আমি উপার্জনের জন্য প্রতিটি ম্যারাথন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে শুরু করি। পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট দূর করার লক্ষ্য নিয়ে, ধীরে ধীরে আমি অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনুষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি ম্যারাথন দৌড়ে পুরস্কার জয়ের উদ্দেশ্যে নিজের খেলার মান উন্নত করার সংকল্প নিই। এর জন্য আমি নিয়মিত অনুশীলন শুরু করি,যাতে নিজের পারফরম্যান্স উন্নত করে প্রতিটি দৌড় প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারি," বারেক আওয়াজ দ্যা ভয়েস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই বলেন।
ম্যারাথন দৌড়বিদ আব্দুল বারেকের সাফল্যলের হাতছানি
বেশি পুরস্কার জয়ের তীব্র ইচ্ছাই ধীরে ধীরে বারেককে ক্রীড়াজগতে সাফল্যের এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। এর জন্য তিনি গভীর নিষ্ঠা ও সম্পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে খেলায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। রাজ্য এবং জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পদক ও ট্রফি জয়ের পর,তিনি ২০০৫ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত বিশ্ব রেলওয়ে অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার ম্যারাথন চ্যাম্পিয়নশিপে ব্যক্তিগত বিভাগে দশম স্থান এবং দলীয় ইভেন্টে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এন.এফ. রেলওয়ের হয়ে বিশ্ব রেলওয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পদক জয়কারী প্রথম খেলোয়াড় ছিলেন বারেক।
“আমার অধ্যবসায়ই আমার সাফল্যের মূল। আমি কখনও আমার অনুশীলনের সঙ্গে আপোষ করিনি। এন.এফ. রেলওয়েতে চাকরি পাওয়ায় আমি যথেষ্ট সুবিধা পেয়েছি, কারণ এখন আর আগের মতো সংসারের কাজের জন্য অনুশীলন বাদ দিতে হয় না। ভারতীয় রেলওয়েতে চাকরি করার পরামর্শ দেওয়ার জন্য আমি প্রাক্তন আন্তর্জাতিক অ্যাথলিট তৈয়রুর নিসাকে অসীম কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। আমি কেন্দ্রীয় আবগারি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর চাকরির জন্যও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম,” বলেন বারেক।
অনুশীলনের গুরুত্ব সম্পর্কে বারেক বলেন, “অনুশীলন, বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাদ্য এই তিনটি উন্নত পারফরম্যান্সের মূল চাবিকাঠি। আমাদের সময়ে কোনো পরিকাঠামো ছিল না। কিন্তু ২০০৭ সালে গুয়াহাটি-তে জাতীয় ক্রীড়া উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আমরা পরিপূর্ণ পরিকাঠামোর সুবিধা পেয়েছি। তবে এখন সমস্যা হচ্ছে, আমাদের যুব খেলোয়াড়দের ক্রীড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। স্মার্টফোন এবং ফাস্ট ফুড যুবসমাজকে নষ্ট করছে। আজকাল বেশিরভাগ যুবক ফাস্ট ফুড খায় এবং মাঠে না গিয়ে মোবাইলে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে। আমি তাদের আহ্বান জানাই, বাইরে বের হও, খেলো, এবং সাফল্য অর্জন করো।”
ম্যারাথন দৌড়বিদ আব্দুল বারেক
খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বারেক বলেন, “আমি যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতাম। আমার বাবা আমাদের জল পানের বদলে দুধ খেতে বলতেন, আর আমি প্রচুর দুধ খেতাম। আমি ফাস্ট ফুড পছন্দ করি না, এবং আমি সবসময় আমাদের প্রধান খাদ্য ভাতের সঙ্গে শাকসবজি খেতে ভালোবাসি।” বারেক আক্ষেপ করে বলেন যে, শহরের যুবক-যুবতীরা পরিশ্রম করতে চায় না, যার ফলে ম্যারাথনের জগতে তাঁর উত্তরসূরি খুঁজে পাওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
“আমি যেহেতু গুয়াহাটি-তে থাকি এবং একটি অ্যাথলেটিকস একাডেমির সঙ্গে জড়িত, তাই আমি সবসময় কয়েকজন ভাল খেলোয়াড় গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু আমার দুঃখ এই যে, গ্রামের যুবক-যুবতীরা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারে না, আর শহরের যুব সমাজ পরিশ্রম করতেই চায় না। বাইহাটা চারিআলি ও মরিগাঁওয়ের কয়েকজন অত্যন্ত প্রতিভাবান যুবক কিছু সময়ের জন্য আমার অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। কিন্তু তারা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থেকে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারেনি এবং এক সময় ছেড়ে দেয়।সফল হতে হলে একজন ম্যারাথন দৌড়বিদের অন্যতম মৌলিক প্রয়োজন হলো সপ্তাহে কমপক্ষে ২০০ কিলোমিটার দৌড়ানো, যা একটি বৈজ্ঞানিকভাবে পরিকল্পিত নির্দিষ্ট সূচির ভিত্তিতে ভাগ করা থাকে,” বলেন ম্যারাথন দৌড়বিদ আব্দুল বারেক।উল্লেখযোগ্য যে,বর্তমানে অসমে ম্যারাথন দৌড় মূলত ছয়গাঁও, দরং ও বরপেটা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।