শান্তি প্রিয় রায়চৌধুরী:
বিশ্ব ফুটবলের কিংবদন্তী ফুটবলার এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো, যাকে সারা বিশ্ব ডেকে থাকে পেলে বলে। আজ ২৩ অক্টোবর, তার ৮৫তম জন্ম বার্ষিকী।
চার দশকেরও বেশি সময় ফুটবল খেলে ১৯৭৭ সালে অবসর নিয়েছেন। বিশ্ব ফুটবলের এই সম্মানিত ব্যক্তি ২০২২ সালে পূথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।
ফুটবল খেলায় সম্রাট চার দশক ধরে যে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়ে গেছেন তা তো আমাদের সকলেরই জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ফুটবল ইতিহাসের বিখ্যাত এই ব্যক্তিটি নিয়ে এমন কিছু গল্প আছে যা অনেকেই হয়তো জানা নেই। আবাক করা গল্প গুলি নিয়েই 'আওয়াজ দ্য ভয়েসের' এই প্রতিবেদন।
কোনো দিন শুনেছেন পেলে লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বহিষ্কার হয়েছেন! শুনেন নি। শুনুন ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায় খেলা হচ্ছিল পেলের ক্লাব সান্তোস এফসির সাথে কলাম্বিয়ান অলিম্পিক স্কোয়াডের। ওটা প্রীতি ম্যাচ ছিল।দর্শকে উপচে পড়ছিল স্টেডিয়াম। হঠাৎই গ্যালারি থেকে ভেসে আসে দর্শকদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। কারনটা কী রেফারি ভেলাসকোয়েজ পেলেকে মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য লাল কার্ডের প্রচলন ঘটেনি।
কলাম্বিয়ার একজন ডিফেন্ডারকে ফাউল করা এবং রেফারির মতে ওই ফুটবলারকে অপমান করার মতো। আর সেই কারণেই পেলেকে মাঠ থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল। ব্যাস, এতেই মাঠের ভেতরে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল। সান্তোসের ফুটবলাররা উত্তেজিত হয়ে রেফারিকে ঘিরে ধরেন। ওই খেলার যেসব ছবি প্রকাশিত হয়েছিল তাতে সেদিন দেখা যায় রেফারি চোখ মুখ কালো হয়ে গেছে। সেসময় দর্শকরাও রেফারির ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে মাঠে নেমে পড়ে ছিল।রেফারি ভেলাসকোয়েজ পরে ২০১০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে সেসময় তাকে মাঠ থেকে বিদায় নিয়ে বাঁশিটা লাইন্সম্যানকে দিতে বলা হয়েছিল। এর পরপরই পেলে আবার মাঠে ফিরে আসেন!
পেলেকে নিয়ে আরেক অবাক করা কান্ড শুনুন,এই পেলেই যুদ্ধ থামিয়েছিলেন। একটি প্রীতি ম্যাচ ছিল যুদ্ধ-বিধ্বস্ত নাইজেরিয়ায়,১৯৬৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। বেনিন সিটিতে অনুষ্ঠিত ওই খেলায় সান্তোস ২-১ গোলে স্থানীয় একাদশকে পরাজিত করে।নাইজেরিয়াতে তখন রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চলছিল।
সান্তোস এফসির ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন এমন একজন গবেষক গুইলহের্ম গুয়াশের মতে, এরকম একটি পরিস্থিতিতে নাইজেরিয়াতে ব্রাজিলের এই ক্লাব গিয়েছিল এই কারণে, ঐ সময় নাইজেরিয়ায় যুদ্ধে লিপ্ত মানুষ গুলো তখন চেয়ে ছিল পেলেকে দেখতে।পেলে সেই ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল। সেদিন মাঠে পেলের খেলা দেখে সবাই আনন্দে মেতে উঠে ছিল। এরপরইপক্ষগুলো তখন যুদ্ধবিরতিতে যেতে সম্মত হয়।
এত বড় ফুটবলার হয়েও কোন দিন ইউরোপীয় ক্লাবে খেলেন নি পেলে! কেন জানেন? পেলেকে নেওয়ার জন্য সেই সময় সান্তোস এফসিকে প্রস্তাব দিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এসি মিলানের মতো ক্লাবও। সেসময় ফুটবলাররা কোন ক্লাবে খেলবেন সে নিয়ে তাদের কথা বলার সুযোগ কম ছিল।
পেলেকে ব্রাজিলে রেখে দেওয়ার জন্য চাপ ছিল ব্রাজিল সরকারের। ১৯৬১ সালের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদ্রস পেলেকে "জাতীয় সম্পদ" হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়ে ছিল তাকে "রপ্তানি করা যাবে না" বলে একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন।পেলে পরে অবশ্য সরকারের অনুমতি নিয়ে একটি বিদেশি ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন। সেটি ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফুটবল ক্লাব নিউইয়র্ক কসমস ক্লাবে।
অবাক কান্ড! পেলেকে কিন্তু একবার "অপহরণ" করা হয়েছিল। সান্তোস এফসি ক্লাবের ফুটবলাররা ১৯৭২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগোতে বিশাল গন্ডগোলের মধ্যে খেলতে গিয়েছিল। তবে একটি সরতে, খেলা শেষ করে সাথে সাথেই তারা প্লেনে উঠে পড়বে। এমন আশ্বাস পাওয়ার পরেই সান্তোস এরখেলোয়াড়রা ওই ম্যাচ খেলতে রাজি হয়েছিল।
কিন্তু বিপদটা হল খেলার ৪৩ মিনিটের মাথায় গোল করে বসেন পেলে। তখনই সবকিছু বদলে যায়। খেলা শেষে পোর্ট অফ স্পেন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে থাকা সমর্থকরা দৌড়ে মাঠের ভেতরে চলে আসে এবং পেলেকে কাঁধে নিয়ে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু সময় লেগেছিল পেলেকে খুজে পেতে।
পেলে শুধু ফুটবলই খেলেন নি, স্ট্যালোনের সঙ্গে ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৮০ সালে যখন 'এসকেপ টু ভিক্টরি' ছবির শুটিং শুরু হয় তখন চলচ্চিত্রাঙ্গনে খ্যাতির তুঙ্গে ছিলেন সিলভেস্টার স্ট্যালোন।এই ছবিতে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ের নাৎসি একাদশ ও বন্দীদের মধ্যে একটি কাল্পনিক ফুটবল ম্যাচের গল্প তুলে ধরা হয়। সেই ছবিটিতে পেলেও অভিনয় করেছেন। তার সঙ্গে ছিলেন ববি মুরের মতো ফুটবলারও। ওই খেলায় গোলরক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেন পেলে।
হ্যাঁ, জেনে রাখুন পেলে কিন্তু ভাল গোলরক্ষকও ছিলেন। পেলে যদি 'এসকেপ টু ভিক্টরি' ছবিতে গোলরক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করতেন তিনি কিন্তু দর্শকদের মোটেও হতাশ করতেন না।বাস্তব জীবনেও তিনি ক্লাব ও দেশের বিকল্প গোলরক্ষক ছিলেন। আসল গোলকিপার আহত হলে তার জায়গায় তিনি নামতেন গোল ঠেকাতে।
পুরো ক্যারিয়ারে পেলে সান্তোস এফসি ক্লাবের হয়ে চারবার গোলরক্ষকের গ্লাভস পরেছিলেন। ১৯৬৪ সালে ব্রাজিলিয়ান কাপের সেমিফাইনালেও তাকে গোলকিপার হতে হয়েছিল। অবাক করার বিষয় হচ্ছে তার টিম সবকটি খেলায় জয় লাভ করেছিল,একটি গোলও খাননি।