বেগম আখতারা আহমেদ: বিটিসির প্রথম মুসলিম মহিলা ই.এম.

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 12 h ago
বিটিসি প্রধান হাগ্রামা মহিলারি এবং বিটিসির প্রথম মুসলিম মহিলা ই.এম বেগম আখতারা আহমেদ
বিটিসি প্রধান হাগ্রামা মহিলারি এবং বিটিসির প্রথম মুসলিম মহিলা ই.এম বেগম আখতারা আহমেদ
 
প্রিয়া শর্মা / গুয়াহাটি 

বিপিএফ সভাপতি হাগ্রামা মহিলারির নেতৃত্বে গঠিত নতুন বিটিসি পরিষদীয় সরকারটি এবার এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। কারণ, এই সরকারে প্রথমবারের মতো একজন মুসলিম মহিলা কার্যনির্বাহী সদস্য (ই.এম.) পদে নিযুক্ত হয়েছেন। বিটিসির মতো একটি অঞ্চলে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা বারবার অবিচারের শিকার হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন, সেখানে একজন মুসলিম মহিলার সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া শুধু তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
 
মথনগুড়ি সমষ্টি থেকে নির্বাচিত হয়ে হাগ্রামা মহিলারির মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া এই মহিলা পরিষদ সদস্যা হলেন বেগম আখতারা আহমেদ। তাঁকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল (পি.এইচ.ই.) বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, গত সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বিটিসি নির্বাচনে বিপিএফ মোট ২৮টি আসন জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ৪০ আসনের এই পরিষদে ইউপিপিএল দল পেয়েছিল ৭টি এবং বিজেপি ৫টি আসন। ২০০৩ সালে বিটিসি গঠনের পর থেকে হাগ্রামা মহিলারি প্রায় পুরো সময়ই ক্ষমতায় ছিলেন, একমাত্র একটি পাঁচ বছরের মেয়াদ ছাড়া।
 
মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা সঙ্গে বেগম আখতারা আহমেদের একটি ছবি
 
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, বেগম আখতারা আহমেদের রাজনীতিতে আসার কোনো পরিকল্পনা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি মূলত সাহিত্যচর্চা করতে চেয়েছিলেন, একজন সাহিত্যিক হওয়াই ছিল তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু জীবনের গতিপথ তো সবসময় পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না; তাঁর ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল।
 
বেগম আখতারা আহমেদের জন্ম বরপেটা জেলার কলগাছিয়া এলাকায়। সেখানেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। যথেষ্ট প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে তিনি বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছেন। তাঁর পিতা ছিলেন এক সরল গ্রামীণ মানুষ, যিনি মেয়েকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বিবাহ দেন, মেয়ের শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি।
 
তাঁর স্বামী ইব্রাহিম আলি মোল্লা, যিনি সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন, ছিলেন একজন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিবাহের পরও বেগম আখতারা হতাশ হননি; বরং তিনি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তবুও তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
 
একটি অনুষ্ঠানে বেগম আখতারা আহমেদ
 
এরপর দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় জন্ম নেয় তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। দুই সন্তানের মা হয়েও তিনি পড়াশোনা থামাননি। সংসার ও মাতৃত্বের দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি নিজের শিক্ষা ও জনজীবন চালিয়ে যান। ২০০৩ সালে তিনি গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
 
এরপর তিনি বঙাইগাঁও জেলার লাংলা মহাবিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন, যদিও খুব বেশি দিন সে কাজ করেননি, কারণ তিনি এরই মধ্যে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কংগ্রেসে যোগ দিয়ে তিনি বরপেটা জেলা মহিলা কংগ্রেসের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তাঁর স্বামীর বাড়ি বিটিসির বাক্সা জেলার মথনগুড়ি সমষ্টির লোয়াহুর গ্রামে। পরবর্তীতে তিনি ঠিকানা পরিবর্তন করে বাক্সা জেলা মহিলা কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পান। দীর্ঘদিন এই পদে থাকার পর ২০০৪ সালে তিনি বিপিএফ-এ যোগ দেন।
 
এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর নতুন রাজনৈতিক জীবন, সংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জে ভরা এক যাত্রা। দলে যোগ দেওয়ার পর সভাপতি হাগ্রামা মহিলারি তাঁকে মহিলা বিপিএফের সভাপতি করে মহিলা শাখা গঠন করেন। অর্থাৎ, বেগম আখতারা আহমেদই মহিলা বিপিএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ২০০৫ সালের বিটিসি নির্বাচনে তিনি দলের নেতা মাখন স্বর্গিয়ারীর হয়ে কাজ করেছিলেন। তিন বছর এই পদে থাকার পর তাঁকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। বর্তমানে তিনি দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদক।
 
বিটিসির নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরবর্তী মুহূর্তের একটি দৃশ্য
 
২০২০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো বিটিসি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তবে তখন বিজেপি প্রার্থী গৌতম দাসের কাছে প্রায় চার হাজার ভোটে পরাজিত হন। কিন্তু এবার একই আসনে দ্বিতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি সেই প্রতিদ্বন্দ্বীকেই চার হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন।
 
যেমন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সহজ ছিল না, তেমনই তাঁর রাজনৈতিক পথও ছিল সংগ্রামময়। যখন বিটিসিতে মুসলমানদের ওপর একের পর এক হামলা হচ্ছিল, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করা হচ্ছিল, তখন তিনিও সেই নির্যাতনের শিকার হন। তাঁর ওপরও হামলা হয়েছিল। বেগম আখতারা আহমেদ জানান, ২০১২ সালে তাঁর তিনটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই বছরেই বিটিসির বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ হয়, বিশেষত বাক্সা জেলায়। তখন তাঁকেও রাজনীতি ছাড়ার জন্য বারবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি এক রাজনৈতিক সভায় উপস্থিত থাকা অবস্থায় তাঁর গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, সৌভাগ্যবশত তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
 
২০১৬ সালেও তাঁর বাড়িতে হামলা হয়; বাড়ির একটি অংশ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তবুও এসব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তাঁকে লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। বরং এইসব বাধা অতিক্রম করেই তিনি আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছেন। যে বিটিসিতে মুসলমানরা এতদিন ধরে অবহেলা ও নিপীড়নের শিকার ছিলেন, সেই বিটিসির মন্ত্রিসভায় একজন মুসলিম মহিলা মন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।
 
বিপিএফ- এর নির্বাচনী সভায় ভাষণ প্রদান করার একটি মুহূর্তে বেগম আখতারা আহমেদ
 
বেগম আখতারা আহমেদের মতে, হাগ্রামা মহিলারির নেতৃত্বের বিশেষত্ব হলো, তিনি সব জাতি ও সম্প্রদায়কে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে চান। তাঁর নেতৃত্বে কাজ করতে পেরে তিনি গর্বিত ও আনন্দিত। ইতিমধ্যেই তিনি ই.এম. হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন এবং অফিসে বসে কাজ শুরু করেছেন।
 
তিনি বলেন, “বিটিসি একটি ছোট অঞ্চল। এর উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সহযোগিতা অপরিহার্য। তাই উন্নয়নমূলক কাজ চালিয়ে যেতে হলে যে সরকারই থাকুক না কেন, তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এগিয়ে যেতে হবে।”