মালিক আসগর হাশমি / মুসৌরি
রাত ৮টা ২০ মিনিট। শীতল বাতাসে স্নান করছে মুসৌরি। দীপাবলির আলোয় ঝলমল করছে পাহাড়ের রানী মুসৌরি। আলো, হাসি, আর মানুষের ভিড়ে ভরে গেছে মল রোড। হালকা ঠান্ডা হাওয়া মুখে লাগছে মিষ্টি পরশের মতো। কেউ পরিবার নিয়ে ঘুরছে, কেউ প্রিয়জনের হাত ধরে ছবি তুলছে, কেউ বা দোকান থেকে কেনাকাটা করছে উৎসাহে। শহরের প্রতিটি কোণ যেন আনন্দের ছোঁয়ায় জীবন্ত।
দীপাবলির দীপ্তি, আলোকসজ্জিত দোকানপাট আর মানুষের মুখের হাসি, সব মিলিয়ে মুসৌরি যেন এক উষ্ণ, মানবিক উৎসবের ছবি। আমি হাঁটছিলাম সেই প্রাণচঞ্চল রাস্তায়, হঠাৎ এক মুহূর্তে সবকিছু বদলে গেল, ভেসে এল মাইকে ধ্বনিত সেই সুর, “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার…”মল রোডের মাঝের এক গলিতে থাকা মসজিদ থেকে মাইকে ভেসে আসছে ইশার আজান।
মুসৌরির জামা মসজিদ
মুসৌরির মতো এক পর্যটন শহরে, যেখানে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ আসে প্রতিদিন, সেখানে আজানের ধ্বনি শুনে আমি বিস্মিত হলাম। মসজিদ থেকে প্রকাশ্যেই ভেসে আসছিল আজান। হয়তো আমার মন অনেকটা ভরে ছিল উত্তরাখণ্ডে মুসলিমদের প্রতি অসহিষ্ণুতার খবর দিয়ে, যেগুলো সোশ্যাল মিডিয়া ও টেলিভিশনে বারবার প্রচারিত হয়েছে।
গুরগাঁও থেকে রওনা হওয়ার আগে আমি গুগলে উত্তরাখণ্ডের মুসলিম সমাজ নিয়ে একটু খোঁজ নিয়েছিলাম। ফলাফল আশাব্যঞ্জক ছিল না। খবর ছিল, কাশ্মীরের কিছু যুবককে দোকান খোলার অনুমতি না দিয়ে মারধর করে তাড়ানো হয়েছে; এক মুসলিম চা-বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; এমনকি কিছু মাতাল ব্যক্তি এক মসজিদে ঢুকে গোলযোগ করেছে।
ল্যান্ডোর জামা মসজিদ
এই সব খবর আমার মনে ভয় ঢেলে দিয়েছিল, কোথাও ঘৃণা বা বৈষম্যের মুখে পড়ব কিনা, সেই চিন্তা তাড়া করছিল আমাকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আজানের ধ্বনি শুনে যেন ভেতরটা আলোয় ভরে গেল। হঠাৎ অন্ধকার ঘরে আলো জ্বলে ওঠার মতো অনুভূতি। আমার সমস্ত ভয় মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। সেই রাতে আমার কাছে মুসৌরির পরিবেশ শুধু আজানের সুরেই নয়, মানবিক সম্প্রীতি, সহনশীলতা ও ঐক্যের জীবন্ত প্রমাণে পরিপূর্ণ মনে হল।
তারপর থেকে আমার চোখে মুসৌরি বদলে গেল। আমি মানুষের দিকে উষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম, দোকানদারদের সঙ্গে কথা বললাম, মুসলিম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাসি বিনিময় করলাম, কোথাও কোনো শত্রুতা, কোনো বৈরিতা পেলাম না। বাস্তবে মুসৌরির চিত্র একেবারেই আলাদা। পরিসংখ্যান বলছে, শহরটিতে প্রায় ৩১,০০০ মুসলমান বাস করেন। পাহাড়ের রানী মুসৌরিতে ঢোকার আগেই চোখে পড়ে একটি বড় মুসলিম কবরস্থান, যা প্রমাণ করে এই সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের উপস্থিতি।
সন্ধ্যার আলোয় মুসৌরির একটি ছবি
মল রোডে হাঁটলে দেখা যায়, বহু দোকানের সাইনবোর্ড উর্দুতে লেখা। পোশাকের দোকান থেকে শুরু করে খাবারের স্টল, হোটেল, ব্যবসার জগতে মুসলিম সমাজের অবদান অপরিসীম। ‘চাচা কা হোটেল’ বা ‘আল-কুরেশ হোটেল’-এর মতো জনপ্রিয় রেস্তোরাঁগুলো পর্যটকদের কাছে বিশেষ প্রিয়। শহরের উল্লেখযোগ্য মসজিদগুলির মধ্যে রয়েছে ল্যান্ডোর জামা মসজিদ, আমানিয়া মসজিদ ও ঝাখান মসজিদ। বিশেষত ল্যান্ডোর মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এই মসজিদগুলো শুধু উপাসনালয় নয়, মুসৌরির ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও ঐক্যের প্রতীক।
স্থানীয় প্রশাসনের মনোভাবও ইতিবাচক। মুসৌরির পুলিশ প্রধান অরবিন্দ চৌধুরী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “মুসলিম সমাজ সম্পর্কে নিচের পাহাড়ের যেসব ধারণা প্রচলিত, মুসৌরির সামাজিক পরিবেশে তার কোনো ছাপ নেই।” এমনকি যখন জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার পর সারা দেশে প্রতিবাদ শুরু হয়, তখন মুসৌরির মুসলিম যুবকরাও ভারতের সমর্থনে সামিল হয়েছিল। আসিফ, কামিল আলি, আয়ুব শাবরি, শহীদ মনসুরের মতো তরুণরা দেশপ্রেমের বার্তা দিয়েছিলেন।
শান্ত ও মনোরম মুসৌরির একটি দৃশ্য
স্থানীয় প্রবীণ মনজুর আহমেদ জানালেন, যিনি একবার মসজিদে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি নেশাগ্রস্ত ছিলেন এবং তাঁর কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। তাই এমন একক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে পুরো সম্প্রদায়কে দোষারোপ করা একেবারেই অন্যায়। আজও মুসৌরিতে পর্যটকদের প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মুসলিম, যা শহরটির সম্প্রীতির প্রমাণ বহন করে।
এই মিলনাত্মক পরিবেশ শুধু মুসৌরিতেই নয়, উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুনেও দেখা যায়। ধামা বাজার, মতি বাজার, পল্টন বাজার ও ডিসপেনসারি বাজারের মতো বাণিজ্যিক এলাকায় অসংখ্য মুসলিম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বোরখা ও হিজাব পরা অসংখ্য মুসলিম নারীকে কেনাকাটা করতে দেখা যায়। দেরাদুনের মহিমান্বিত জামা মসজিদ এখানকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। উত্তরাখণ্ডের এই সম্প্রীতির ঐতিহ্য শুধু বর্তমানেই সীমাবদ্ধ নয়, এর ইতিহাসও সমান সমৃদ্ধ ও অনুপ্রেরণাদায়ক।
পাহালগাম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুসৌরিতে মুসলিমদের বিক্ষোভের একটি ছবি
১৯৩১ সালে আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় খলিফা হজরত মুসলেহে মাওউদ (মির্জা বশিরউদ্দিন মাহমুদ আহমদ) মুসৌরি সফর করেন। তাঁর এই সফর ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও ইসলাম প্রচারের নীতিতে ভিত্তিক। ১৯৩১ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি কাদিয়ান থেকে মুসৌরিতে আসেন। ২৪ এপ্রিল তিনি মুসৌরির আহমদিয়া মসজিদে জুমার খুতবা প্রদান করেন। তিনি বলেন, “ভারতের একমাত্র পাহাড়ি শহর মুসৌরিতেই আহমদিয়া মুসলিমদের নিজস্ব মসজিদ আছে,” যা তাঁদের ধর্ম প্রচার ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বের প্রতীক।
২৬ এপ্রিল তিনি মুসৌরির টাউন হলে “ভারতের অগ্রগতি ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য” বিষয়ক এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের তিনটি মূল কারণ, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পার্থক্য। তিনি ব্যাখ্যা করেন, “ধর্মীয় উৎসব নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় কারণ আমরা সহিষ্ণুতার প্রকৃত অর্থ জানি না। সহিষ্ণুতা মানে কেবল সহ্য করা নয়, বরং অন্য ধর্মকে তার নিজস্ব পরিসরে সম্মান দেওয়া।” তিনি আহ্বান জানান, সব ধর্ম যেন একে অপরের মহাপুরুষদের সম্মান করে এবং নিজের ধর্ম প্রচারে অন্য ধর্মকে অবমাননা না করে।
মুসৌরি মসজিদে হযরত মুসলেহ-ই-মওউদ -এর বক্তৃতা দেওয়ার একটি দৃশ্য
রাজনৈতিক সমাধানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের উচিত মুসলমানদের প্রতি কিছু রাজনৈতিক ছাড় দেওয়া এবং তাঁদের আশ্বস্ত করা যে, কোনো বিদেশি (এমনকি মুসলিম দেশ) আক্রমণ করলে তারা ভারতের পক্ষে দাঁড়াবে।”
১ মে তিনি দেরাদুনে যান, সেখানে ইসলামিয়া স্কুলে এক জনসভায় বক্তৃতা দেন। ২ মে দিল্লিতে গিয়ে আহমদিয়া জামাতের কর্মীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “প্রত্যেক মুসলমানের উচিত একজন প্রচারক হয়ে ওঠা।” ইসলামের প্রকৃত চেহারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে হলে মুসলমানদের হতে হবে সত্যবাদী, বিনয়ী ও সমাজসচেতন।
আমি উপলব্ধি করলাম, মুসৌরি কেবল একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়; এটি ভারতের সেই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, যেখানে একই রাস্তায় মন্দির ও মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি, আর মানুষের হৃদয় ভরপুর ভালোবাসায়।