প্রাণের শিল্পীর প্রতি এক অনন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি — নিজের অর্থে জুবিন গার্গের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি গড়লেন শিল্পী নুরুদ্দিন আহমেদ

Story by  Ariful Islam | Posted by  Aparna Das • 15 h ago
শিল্পী নুরুদ্দিন আহমেদ এবং জুবিন গার্গের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি
শিল্পী নুরুদ্দিন আহমেদ এবং জুবিন গার্গের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি
 
আরিফুল ইসলাম / গুয়াহাটি 

জুবিনবিহীন এক মাসেরও বেশি সময় পার করেছে অসমবাসী। প্রাণের  শিল্পীর প্রয়াণের পর থেকেই গোটা অসমবাসী নানা উপায়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শ্রাদ্ধের আয়োজন করে চলেছে। সেই আবেগ ও ভালোবাসাকে ভিন্ন এক রূপে প্রকাশ করলেন আরেকজন শিল্পী, সম্পূর্ণ নিজের খরচে নির্মাণ করলেন লুইতকণ্ঠ জুবিন গার্গের এক সুউচ্চ পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কলা নির্দেশক, সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারপ্রাপক এবং বিশিষ্ট ভাস্কর শিল্পী নুরুদ্দিন আহমেদের হাতে প্রাণ পেল এই অমর শিল্পীর প্রতিমূর্তিটি।
 
যেখানে সাধারণত এই ধরনের মূর্তি নির্মাণে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়, সেখানে নিজের অর্থে মাত্র আঠারো দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি করলেন নুরুদ্দিন আহমেদ। জুবিন গার্গের একমাস পূর্তির শ্রাদ্ধ উপলক্ষে প্রিয় শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তৈরি করলেন এই মূর্তিটি।
 
জুবিন গার্গের পূর্ণাঙ্গ প্রতিমূর্তিটির একটি ছবি
 
‘আওয়াজ-দ্যা ভয়েস’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নুরুদ্দিন আহমেদ বলেন, “এই মূর্তিটা আমি সম্পূর্ণ নিজের খরচে বানিয়েছি। জুবিন আর আমি একই এলাকার মানুষ, আমরা একসঙ্গে থেকেছি। কখনও ভাবিনি জীবিত অবস্থায় আমাকে জুবিনের মূর্তি তৈরি করতে হবে। ও আমার চেয়ে ছোট ছিল, আমাকে দাদা বলত। কাহিলিপাড়ায় সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাস করে, তাই আমরা প্রায়ই সর্বধর্মীয় প্রার্থনার আয়োজন নিয়ে আলোচনা করতাম।”
 
তিনি আরও বলেন, “আমার বড় ছেলের সঙ্গে কথা বলে আমরা ঠিক করলাম জুবিনের একটি মূর্তি তৈরি করব। অক্টোবরের ৩ তারিখে কাজ শুরু করি এবং ১৮ দিনের মধ্যেই শেষ করি। আমি জুবিনকে খুব ভালোবাসতাম, তাই সম্পূর্ণ নিজের খরচেই এটি বানিয়েছি। মূর্তিটি আমি জুবিনের স্ত্রী গরিমা শইকীয়া গার্গকে উপহার দেব।”
 
শিল্পী নুরুদ্দিন আহমেদ এই মূর্তিটি গরিমা গার্গের হাতে তুলে দেবেন, তবে তিনি অনুরোধ করেছেন যেন এটি কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে স্থাপন না করা হয়। তাঁর ইচ্ছা, অন্য কোনও সর্বজনীন স্থানে এটি স্থাপন করা হোক।
 
সাধারণত এমন মূর্তি তৈরি করতে দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়, কিন্তু নুরুদ্দিন আহমেদ খরচের কথা একেবারেই ভাবেননি। তিনি ফাইবার গ্লাস এবং মার্বেল ডাস্ট দিয়ে মূর্তিটি তৈরি করেছেন, যা তাঁর স্বাভাবিক কাজের তুলনায় অনেক দ্রুত সময়ে সম্পন্ন হয়েছে। এটি হল হৃদয়ের শিল্পী জুবিন গার্গের প্রথম সুউচ্চ পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। শিল্পীর একমাস পূর্তির শ্রাদ্ধ উপলক্ষে ১৯ অক্টোবর কাহিলিপাড়ার ফরেনসিক সায়েন্স কলেজ মাঠে উন্মোচন করা হয় এই সূর্যকণ্ঠের প্রতিমূর্তিটি।
 
প্রতিমূর্তিটি উদ্বোধন করার মুহূর্তের একটি দৃশ্য
 
স্থানীয় বাসিন্দা ধ্রুবজ্যোতি শর্মা বলেন, “আমাদের শ্রদ্ধেয় নুরুদ্দিন আহমেদের স্নেহস্পর্শে তৈরি হয়েছে আমাদের প্রিয় শিল্পী জুবিন গার্গের এই মূর্তিটি। একমাস পূর্তির শ্রাদ্ধ উপলক্ষে কাহিলিপাড়ার মানুষজনের উপস্থিতিতে উন্মোচন করা হয়েছে। যদিও আমাদের মনে দুঃখ আছে, তবু আমরা আহমেদ দাদাকে ধন্যবাদ জানাই, তাঁর হাতের পরশে এত সুন্দরভাবে তৈরি হয়েছে এই মূর্তি। উন্মোচনের সময় বিপুল মানুষের সমাগম হয়েছিল। আমরা সবাই এখনও ন্যায়ের প্রত্যাশায়।"
 
টোকারী গীতের সম্রাট ও জুবিন গার্গের ভ্রাতৃসম প্রখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী খগেন গগৈ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেন মূর্তিটি। এক হাতে গিটার, অন্য হাতে মাইক্রোফোন এবং মাথায় 'গামোচা' (অসমীয়া গামছা) পেঁচানো সেই পূর্ণাঙ্গ মূর্তিটি উন্মোচন করে খগেন গগৈ বলেন, “বিশিষ্ট ভাস্কর শিল্পী নুরুদ্দিন আহমেদ নিজের খরচে তৈরি করা এই মূর্তিটি উন্মোচন করতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ। বৃহত্তর কাহিলিপাড়াবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত একমাস পূর্তির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূর্তিটি উন্মোচন করা হয়েছে। জুবিন গার্গের মৃত্যুর পর এটি তাঁর প্রথম মূর্তি। জুবিন আমার হৃদয়ে বেঁচে আছেন। তাঁর সঙ্গে অনেক হাসি-ঠাট্টা করেছি। তাই তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ মূর্তি উন্মোচন করতে পেরে আমি গভীরভাবে আনন্দিত।”
 
অন্যদিকে, অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক সদানন্দ গগৈ বলেন, “মানুষের হৃদয়ে জুবিন গার্গ চিরকাল বেঁচে থাকবেন। আসাম জাতির জন্য এটি এক বিরাট দুর্ভাগ্য যে আমরা আমাদের প্রাণের শিল্পীকে মাঝপথে হারিয়ে ফেলেছি।” তাঁর মতে, জুবিন গার্গের মতো শিল্পী কয়েক দশকে একবারই জন্ম নেন। তাঁর মৃত্যু গোটা জাতির জন্য এক বিশাল ক্ষতি।
 
উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা প্রাঞ্জল শইকীয়া, সংগীত পরিচালক ড. হিতেশ বোরুয়া সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও কাহিলিপাড়ার নাগরিকবৃন্দ। একমাস পূর্তির শ্রাদ্ধ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় সর্বধর্ম প্রার্থনা সভা, ভাগবত পাঠ, কোরআন শরিফ পাঠ, গুরু গ্রন্থ সাহিব পাঠ, বাইবেল পাঠ, প্রার্থনা, দিহানাম, গায়ন-বায়ন, বোরগীত, টোকারী গীত, জিকির ও মহিলাদের দিহানাম পরিবেশনা।
 
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত গরিমা শইকীয়া গার্গ
 
শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ফরেনসিক বিজ্ঞানাগার মাঠ প্রাঙ্গণ। পাশাপাশি, জুবিন গার্গের অমর সৃষ্টি ‘মায়াবিনী রাতির বুকুত...’ শীর্ষক গানটি সকলেই মিলিতভাবে পরিবেশন করেন।সন্ধ্যায় বৃহত্তর কাহিলিপাড়াবাসী নিজ নিজ বাড়ির প্রাঙ্গণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রিয় শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
 
‘শ্রদ্ধাঞ্জলি–জুবিন সমন্বয় রক্ষা সমিতি’র পক্ষ থেকে মুখ্য সমন্বয়ক ড. রাজেন্দ্রনাথ খাউণ্ড, হিরণ্য কুমার বরা, নুরুদ্দিন আহমেদ ও সমন্বয়ক ধর্মেশ্বর ফুকনের আহ্বানে কাহিলিপাড়াবাসী এই বস্তি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে তাঁদের প্রাণের শিল্পী জুবিন গার্গের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।