শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
হুগলির চন্দননগর, একসময় ফরাসিদের উপনিবেশ, আজ বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানবিক সৌহার্দ্যের প্রতীক। ইউরোপীয় প্রশাসনের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছিল দালান, রাস্তা, চার্চ ও প্রশাসনিক ভবন, কিন্তু চন্দননগর তার নিজস্ব ভারতীয় চেতনা কখনো হারায়নি। বরং এই শহর গড়ে তুলেছে ধর্মীয় সহাবস্থান ও সংস্কৃতির মিলনের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
শহরের প্রতিটি কোণায় ইতিহাসের গন্ধ। গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ফরাসি দালান যেন পাশের বাংলার মাটির ঘরের সঙ্গে কথোপকথনে মগ্ন। একদিকে ‘সাঁ-জোসেফ চার্চ’, যার ঘণ্টাধ্বনি আজও শহরকে জাগিয়ে তোলে, অন্যদিকে ‘নন্দদুলাল মন্দির’, শিখরশৈলীর এক অনন্য সৃষ্টি। পাশে রয়েছে একাধিক প্রাচীন মসজিদ, যেখান থেকে ভোরের আজানে মুখরিত হয় চন্দননগরের আকাশ।
চন্দননগরে অবস্থিত একটি মন্দিরের ছবি
সপ্তদশ শতকে ফরাসিরা যখন হুগলির তীরে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে, তখন থেকেই চন্দননগর আধুনিক শহররূপ পেতে শুরু করে। ইউরোপীয় প্রভাব থাকলেও এখানকার মানুষ নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। বরং ফরাসি প্রশাসনও স্থানীয় ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়েছিল। এর ফলেই গড়ে ওঠে এমন এক সমাজ যেখানে খ্রিস্টান, হিন্দু ও মুসলমান, তিন সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে উৎসব পালন করেন, একে অপরের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা জানান।
ইতিহাসবিদ দেবাশিস মুখার্জি বলেন, “চন্দননগর এমন এক শহর, যেখানে উপনিবেশিক শাসন ধর্মীয় বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্যের মঞ্চ তৈরি করেছিল। ফরাসি প্রশাসনের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও স্থানীয়দের সহনশীলতা একে করেছে অনন্য।”
আজও এই ঐক্যের ঐতিহ্য জীবন্ত। বড়দিনে সাঁ-জোসেফ চার্চ আলোকিত হয়ে ওঠে, আর জগদ্ধাত্রী পুজোয় পুরো শহর আলোয় রঙিন। রমজান মাসে মসজিদে ইফতারের আমন্ত্রণে সব ধর্মের মানুষ একত্রিত হন। প্রতিবেশীরা একে অপরের উৎসবে যোগ দেন, কেউ বড়দিনে কেক পাঠান, কেউ আবার দুর্গাপুজোর ভোগে আহ্বান জানান সবাইকে। চন্দননগরের স্থাপত্যেও এই মিলনের ছাপ স্পষ্ট। ইউরোপীয় গথিক ধাঁচের চার্চের পাশে দেখা যায় বৈষ্ণব শৈলীর নন্দদুলাল মন্দির, আর কাছেই মসজিদের মিনার। ভিন্ন স্থাপত্য, ভিন্ন ধর্ম, তবু একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
চন্দননগর স্ট্যান্ডে অবস্থিত চার্চের একটি ছবি
চন্দননগর পৌরসভার এক কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের শহর শুধু ফরাসি ঐতিহ্যের জন্য নয়, ধর্মীয় সহনশীলতার জন্যও গর্বিত। পর্যটকরা এখানে এসে অবাক হন, কেমন করে তিন ধর্মের চিহ্ন এত সুন্দরভাবে মিশে গেছে।” এই শহরের জীবনে ধর্মের ভিন্নতা নয়, বরং মানবতার সেতুবন্ধই মূল শক্তি। গঙ্গার ঘাটে সন্ধ্যার আরতিতে, চার্চের প্রার্থনায়, মসজিদের আজানে, প্রতিটি সুরেই মিশে আছে সহাবস্থানের বার্তা।
আজ যখন বিশ্বের নানা প্রান্তে ধর্মীয় বিভাজন ক্রমেই প্রকট হচ্ছে, তখন চন্দননগর শান্তভাবে জানিয়ে দেয় এক মূল্যবান বার্তা, বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য, সহাবস্থানই শক্তি। গঙ্গার বাতাসে আজও ভেসে আসে মন্দিরের ঘণ্টা, চার্চের ঘণ্টাধ্বনি আর মসজিদের আজান, একসঙ্গে। সেই মেলবন্ধনের সুরেই চন্দননগর বেঁচে আছে হুগলির হৃদয়ে, বাংলার আত্মায়।