গুয়াহাটির ধারাপুরে ৮২ বছরের সম্প্রীতির শ্যামা পুজো: হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে পালন করছেন আলোর উৎসব

Story by  Munni Begum | Posted by  Aparna Das • 10 d ago
 গুয়াহাটির ধারাপুর চারিআলির নবনির্মিত শ্রীশ্রী কালী মন্দিরে অনুষ্ঠিত  শ্যামা পুজো
গুয়াহাটির ধারাপুর চারিআলির নবনির্মিত শ্রীশ্রী কালী মন্দিরে অনুষ্ঠিত শ্যামা পুজো
 
মুন্নী বেগম / গুয়াহাটি 
 
গুয়াহাটির এমন এক শ্যামা পুজো, যা আজ আর শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি পরিণত হয়েছে ৮২ বছরের এক সম্প্রীতির ইতিহাসে। যেখানে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় গড়ে তুলেছে বিশ্বাস, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সহাবস্থানের এক অটুট বন্ধন। কারণ এই পুজোয় ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে মুসলমানরাও সমানভাবে অংশ নেন, হিন্দুদের মতোই নিষ্ঠা ও ভালোবাসা নিয়ে।
 
পুজোর প্যান্ডেল সাজানো, মন্দির চত্বর পরিষ্কার করা, প্রসাদ ও ভোগ পরিবেশনে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরাও এগিয়ে আসেন। এই পুজো অনুষ্ঠিত হয় গুয়াহাটির ধারাপুর চারিআলির নবনির্মিত শ্রীশ্রী কালী মন্দিরে।
 
ধারাপুর চারিআলিতে নবনির্মিত শ্রী শ্রী শ্যামা মন্দির
 
‘আওয়াজ- দ্যা ভয়েস’-এর সঙ্গে এক কথোপকথনে ধারাপুর চারিআলির নবনির্মিত শ্রীশ্রী শ্যামা পুজো উদযাপন সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিরেন কলিতা বলেন, “দক্ষিণ কামরূপের ধারাপুর অঞ্চলটি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষে পরিপূর্ণ। প্রায় ৮২ বছর আগে, দুই সম্প্রদায়ের যৌথ প্রচেষ্টায় এখানে মা কালী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ এই মন্দিরটি সম্প্রীতির এক প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর কালীপুজোর সময়, হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিমরাও উৎসবের প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। মন্দির পরিষ্কার করা, প্যান্ডেল সাজানো, প্রসাদ পরিবেশন, এমনকি আর্থিক অনুদানেও তাঁরা এগিয়ে আসেন। তাঁরা যেমন আন্তরিকভাবে ঈদ পালন করেন, তেমনি দূর্গাপুজো, কালীপুজো ও লক্ষ্মীপুজোও সমান আন্তরিকতায় পালন করেন। পুজোর সময় তাঁরা ফটকা ফোটান, আনন্দ করেন, রঙিন আলোয় উদযাপন করেন। এবছরও তার ব্যতিক্রম নয়—এইবারও প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলমান এই কালীপুজোর আয়োজনে সহায়তা করেছেন।”
 
দক্ষিণ কামরূপ অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ কালী মন্দির হিসেবে পরিচিত ধারাপুরের এই শ্রীশ্রী কালী মন্দিরকে ঘিরে জনবিশ্বাস আছে যে, এখানে পুজো দিলে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। তাই দূরদূরান্ত থেকে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষও এখানে আসেন।
 
দীপাবলি উপলক্ষে  আলোকিত ধারাপুর চারিআলির একটি মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যক্তির ঘর
 
মন্দিরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত জাকির আলি বলেন, “আমি প্রতি বছর মন্দিরের সব ধরনের কাজে যুক্ত থাকি। এবছরও যতটা পারি সাহায্য করেছি। আমাদের কাছে এই মন্দির কেবল হিন্দুদের নয়, এটি ধারাপুরের প্রতিটি মুসলমানের কাছেও পবিত্র। মন্দির প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই মুসলমানরাও এখানে পারা, ছাগল ইত্যাদি উৎসর্গ করে আসছেন। আমাদের বিশ্বাস, মন্দির চত্বরের পুকুরের জলে স্নান করলে বসন্ত রোগ সারিয়ে তোলে। তাই কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে সেই পুকুরে গিয়ে স্নান করার এক প্রাচীন প্রথা এখনও চলে আসছে।”
 
আজারা রাজস্ব অঞ্চলের অন্তর্গত বৃহত্তর ধারাপুর মূলত কৃষিনির্ভর এলাকা। বহু বছর ধরে এখানকার নেহালি বালিচর অঞ্চলে উৎপন্ন শাকসবজি ধারাপুর চারিআলির বাজারে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এই বাজারকেই কেন্দ্র করে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে মন্দিরটি আগের স্থান থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে।
 
ধারাপুর চারিআলি কালী মন্দিরের সম্মুখের বাজারের দৃশ্য
 
শ্যামা পুজো উদযাপন সমিতির উপদেষ্টা ভবেশ কলিতা বলেন, “ধারাপুরে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। এখানে মোট ২৪টি পাড়া আছে, যার মধ্যে মজিল পাড়াটি সম্পূর্ণ মুসলমান অধ্যুষিত, প্রায় ১২০০ জনের বাস। এই পাড়ার প্রত্যেকেই প্রতি বছর পুজোর সময় সাহায্য ও সহযোগিতা করেন। দীপাবলির সময় তাঁরা নিজেদের বাড়িতেও কলাপাতা পুঁতে, মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসব উদযাপন করেন।
 
এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এলাকার মুসলিমরা, মোহাম্মদ বরকত আলি, আলতাফ হুসেইন, বাখরু আলি, প্রয়াত হারেज़ আলি, অনোয়ার হুসেইন প্রমুখ, পুজোয় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা ভক্তদের জন্য খিচুড়ি, পায়েস, নৈবেদ্য পরিবেশন করেন। তাঁদের কাছে এই মন্দির শুধু হিন্দুদের উপাসনাস্থল নয়, এটি তাঁদেরও শ্রদ্ধার স্থান। পুজোর সময় এটি স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। এবছরও তিনদিনব্যাপী পুজোয় প্রায় ২০টি মুসলিম পরিবার ভোগ দেবে এবং তাঁদের ঘরেও ও মন্দির চত্বরে মাটির প্রদীপ জ্বেলে দীপাবলি উদযাপন করবে।”
 
জুবিন গার্গকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর ব্যবস্থা ধরা পড়ে শ্রী শ্রী শ্যামা পুজো উদযাপন সমিতির
 
ধারাপুর চারিআলি শ্যামা পুজো সমিতি জানিয়েছে, আগামী ২০ থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠান চলবে।
 
হিরেন কলিতা বলেন, “পুজোর প্রথম দিন বৃক্ষরোপণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান হবে এবং অসমের প্রিয় শিল্পী জুবিন গার্গকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হবে। ২১ অক্টোবর নামকীর্তন, মহিলাদের নাগারা নাম পরিবেশন ও দীপান্বিতা উদযাপন হবে। ২২ অক্টোবর নামকীর্তন ও নাগারা নামের অনুষ্ঠান থাকবে। যেহেতু আমরা আমাদের প্রিয় শিল্পীকে হারিয়েছি, তাই এবছর দীপাবলিতে ফটকা ফোটানো থেকে বিরত থেকে শুধু মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপান্বিতা পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”