আশা খোসা
স্বাধীনোত্তর ভারতের ইতিহাসে বহু নারী তাদের অদম্য সাহস, প্রতিভা ও নেতৃত্ব দিয়ে সমাজে নারীর মর্যাদা ও অবস্থানকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে এমন পথ দেখিয়েছেন, যা আজকের নারীদের সমান তালে পুরুষের সঙ্গে চলতে শিখিয়েছে, আধুনিকতার পথে এগিয়ে দিয়েছে, তবু শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেছে।
ইন্দিরা গান্ধী
সত্তরের দশকে এক প্রবাদ ছিল— “ইন্দিরা গান্ধী কা রাজ হ্যায়”— যা পুরুষদের মুখে নারীর সর্বোচ্চ নেতৃত্বের স্বীকৃতি হয়ে উঠেছিল। ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ভারতের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় তাঁর নেতৃত্বেই সম্ভব হয়। একসময় যাকে পুরুষ নেতারা “গুঙ্গি গুড়িয়া” বলে হেয় করেছিলেন, সেই ইন্দিরা গান্ধী দেশকে সামরিক জয়ে পৌঁছে “দুর্গা” রূপে অভিষিক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী
যদিও ১৯৭৪ সালের জরুরি অবস্থা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিতর্কিত অধ্যায়, তবুও পরবর্তীতে নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এক বিরল উদাহরণ স্থাপন করেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময় থেকেই ভারতীয় নারীরা দৃঢ় পদক্ষেপে জাতির উন্নয়নে নিজেদের স্থান করে নেয়।
কিরণ বেদি
১৯৭২ সালে প্রথম মহিলা আইপিএস অফিসার হিসেবে কিরণ বেদির আবির্ভাব যেন ভারতীয় নারীর কল্পনাশক্তিকে নতুন করে জ্বালিয়ে দিল। তখন ইন্টারনেট বা সামাজিক মাধ্যমের প্রচার ছিল না, তবু দিল্লির রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়ানো “ক্রেন বেদি” সবার নজর কেড়েছিলেন।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ডেপুটেশনে কিরেন বেদী
এমনকি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কনভয়ের একটি গাড়িও তিনি সরিয়ে দেন— যা তাঁর নির্ভীক চরিত্রের প্রতীক হয়ে ওঠে। আজ সেনাবাহিনী বা পুলিশের কাতারে অসংখ্য নারীর উপস্থিতি কিরণ বেদিরই অনুপ্রেরণার ফসল।
পি.টি. উষা
কেরালার পায়োলি গ্রামের সমুদ্রসৈকতে খালি পায়ে দৌড়ানো এক কিশোরী একদিন জাতীয় ক্রীড়াঙ্গনে ভারতকে গর্বিত করবে— কে জানত! “পায়োলি এক্সপ্রেস” নামে খ্যাত পি.টি. উষা আশির দশকে ভারতীয় নারীর ক্রীড়াঙ্গনে নতুন অধ্যায় সূচনা করেন।
ট্র্যাকে পি টি উষা
৯৮৪ সালের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ৪০০ মিটার হার্ডলসে মাত্র ১/১০ সেকেন্ডের জন্য পদক হাতছাড়া হলেও তিনি প্রমাণ করেছিলেন— ভারতীয় নারীরা বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় সমানে টক্কর দিতে পারে। আজও তাঁর অ্যাকাডেমি নতুন প্রজন্মের ক্রীড়াবিদ গড়ে তুলছে।
সুষমা স্বরাজ
পুরুষ-প্রধান রাজনৈতিক পরিসরে সুষমা স্বরাজের উত্থান ছিল অসাধারণ। বিরোধী দলনেত্রী থেকে শুরু করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং শেষপর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী— প্রতিটি ভূমিকায় তিনি ছিলেন দৃঢ়, স্পষ্টভাষী এবং মানুষের কাছে পৌঁছতে পারদর্শী।
ভারতের বিদেশমন্ত্রী হিসেবে সুষমা স্বরাজ
বিশেষত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিপদে পড়া ভারতীয়দের সরাসরি সাহায্য করতেন। তাঁর তৎপরতা ও সহানুভূতিশীল মনোভাব তাঁকে মানুষের কাছে “জনতার মন্ত্রী” করে তুলেছিল।
সিমি গেরিওয়াল
অভিনয় জীবনের বাইরে সিমি গেরিওয়াল ভারতীয় টেলিভিশনকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন। Rendezvous with Simi Garewal অনুষ্ঠানের সাদা-শুভ্র সেট, মসৃণ উপস্থাপনা ও আন্তরিক আলাপচারিতা— সব মিলিয়ে তিনি সেলিব্রিটি সাক্ষাৎকারকে এক অন্য রূপ দেন। প্রযোজনা, পরিচালনা— সব ক্ষেত্রেই তাঁর সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণ নারী ক্ষমতায়নের উদাহরণ হয়ে থাকে।
সিমি গেরিওয়াল
শেহনাজ হুসেন
প্রাকৃতিক উপাদান ও প্রাচীন রূপচর্চার রেসিপি দিয়ে তৈরি প্রসাধনী ব্র্যান্ড “Shahnaz Herbal” তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। শুধু ব্যবসা নয়, তিনি সৌন্দর্য প্রশিক্ষণকে পেশাগত শিক্ষায় পরিণত করে হাজারো নারীকে আর্থিক স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে দেন। তাঁর ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলের মাধ্যমে বহু নারী ঘরে বসেই সৌন্দর্য সেবা ব্যবসা শুরু করতে সক্ষম হন।
রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের কাছ থেকে পদ্মশ্রী গ্রহণ করছেন শেহনাজ হুসেন
সুধা মূর্তি
একজন সফল প্রকৌশলী, লেখক, সমাজকর্মী ও দাতব্য সংস্থার প্রধান— সুধা মূর্তির জীবন যেন বহুমুখী প্রেরণার উৎস। ইনফোসিস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রন্থাগার নির্মাণ থেকে শুরু করে গ্রামীণ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম সরল ভাষায় মানবিক মূল্যবোধ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরে।
সুধা মূর্তি সরলতা এবং করুণার প্রতীক
জোয়া আখতার
নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকার জোয়া আখতার বলিউডকে নতুন ধাঁচের গল্প বলার কৌশল উপহার দিয়েছেন। বাস্তব চরিত্র, সূক্ষ্ম আবেগ ও আধুনিক জীবনধারার টানাপোড়েন তাঁর ছবিকে আলাদা করেছে। Zindagi Na Milegi Dobara, Gully Boy, Made in Heaven— প্রতিটি কাজেই তিনি প্রমাণ করেছেন, বাণিজ্যিক সাফল্য ও শিল্পমান একসঙ্গে সম্ভব।
চলচ্চিত্র নির্মাতা জোয়া আখতার
রিনি সাইমন-খান্না
আশি ও নব্বইয়ের দশকে অল ইন্ডিয়া রেডিও ও দূরদর্শনের সংবাদ কক্ষ এখনও পুরুষ-প্রধান ছিল। সেখানেই রিনি সাইমন-খান্না তাঁর গভীর, স্বচ্ছন্দ ও কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে সংবাদ পাঠের নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেন।
রিনি সাইমন-খান্না
তাঁর কণ্ঠস্বর দিল্লি মেট্রো ঘোষণাপত্র থেকে শুরু করে জাতীয় অনুষ্ঠান— সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সংবাদপাঠে নারীর কণ্ঠও সমানভাবে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রভাবশালী হতে পারে।
বাচেন্দ্রী পাল
উত্তরাখণ্ডের নাকুরি গ্রামের এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে বাচেন্দ্রী পাল ১৯৮৪ সালের ২৩ মে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখে সারা বিশ্বের কাছে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করে তিনি প্রথম ভারতীয় নারী এবং বিশ্বের পঞ্চম নারী হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। এই সাফল্য ছিল শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জয় নয়, বরং ভারতীয় নারীর ক্ষমতায়নের পথে এক বিরাট অগ্রগতি।
শৈশবেই পাহাড়ের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা জন্ম নেয়। ছোটবেলায় পাহাড়ি পথে খেলাধুলা এবং চড়াই-উৎরাই তাঁকে সাহসী করে তোলে। পরিবার তাঁকে শিক্ষক হওয়ার জন্য পড়াশোনা করাতে পাঠালেও, বাচেন্দ্রী পেশাদার পর্বতারোহী হওয়ার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরেন। পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের মন ও স্বপ্নকে অনুসরণ করে তিনি প্রমাণ করেন—দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনো বাধাই অতিক্রম করা অসম্ভব নয়।
এভারেস্টে বাচেন্দ্রী পাল (একদম ডানে)
১৯৮৪ সালের চতুর্থ ভারতীয় এভারেস্ট অভিযানে তাঁর ঐতিহাসিক সাফল্য তাঁকে রাতারাতি জাতীয় আইকনে পরিণত করে। শুধু এভারেস্টই নয়, পরবর্তী সময়ে তিনি নেতৃত্ব দেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে, যার মধ্যে রয়েছে ইন্দো-নেপালি মহিলা এভারেস্ট অভিযান এবং সাহসী “গঙ্গা র্যাফটিং অভিযান”। এসব অভিযানে তিনি শুধু নিজের দক্ষতা নয়, দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতাও প্রদর্শন করেন।
বছরের পর বছর ধরে বাচেন্দ্রী পাল অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে অনুপ্রাণিত করেছেন—নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে, সমাজের বাঁধা ও সীমাবদ্ধতা ভেঙে ফেলতে। তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব ও সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পদ্মশ্রী-সহ বহু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেছেন।
আজও তিনি ভারতীয় নারীর সংগ্রাম ও সাফল্যের প্রতীক হয়ে আছেন—যিনি প্রমাণ করেছেন যে, মনের শিখর জয় করতে পারলেই পৃথিবীর যেকোনো শিখর জয় করা সম্ভব।