ধর্ম নয়, ভক্তিই আসল; আগরতলার মুসলিম যুবক কাসেম মিয়ার বাড়িতে কালীপূজার আয়োজনের ব্যতিক্রমী নজির

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 11 d ago
আগরতলার মুসলিম যুবক কাসেম মিয়ার বাড়িতে কালীপূজার আয়োজন
আগরতলার মুসলিম যুবক কাসেম মিয়ার বাড়িতে কালীপূজার আয়োজন
 
নূরুল হক/  আগরতলা

দীপাবলির উৎসবকে সামনে রেখে এক ভিন্ন ধরনের কালী পূজার আনন্দে মেতে উঠেছেন ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা সংলগ্ন পশ্চিম নোয়াবাদী এলাকার সম্প্রীতি প্রিয় মানুষ। পশ্চিম নওয়াবাদীতে বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও দীপাবলিতে ত্রিপুরেশ্বরী মায়ের আরাধনা হবে এক মুসলিম বাড়িতে। বাড়ির একমাত্র ছেলে কাসেম মিয়া(৩৪) নিয়ম মেনে বিগত ১৫ বছর যাবত নিজের বাড়িতে ত্রিপুরেশ্বরী মায়ের আরাধনা করছেন। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া কাসেম মিয়ার বাড়িতে কালী মায়ের পূজার অনুষ্ঠান ত্রিপুরার সম্প্রীতির চিত্রে এক নতুন রংয়ের চমক হয়ে উঠেছে।
 
কাসেম মিয়ার বাড়িতে বিগত ১৫ বছর যাবত প্রতিষ্ঠিত রয়েছে ত্রিপুরেশ্বরী কালী মায়ের প্রতিমা। প্রতিবছর দীপাবলীর আমাবস্যা তিথিতে নিয়ম মেনে মায়ের পূজায় ব্রতী হন কাসেম মিয়া এবং তার পরিবার। মুসলিম হলেও কাসেম মিয়া নিজেই নিয়ম মেনে মায়ের পূজা করেন। মায়ের প্রতি অঘাত বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং ভক্তির দরুন তিনি ধারণ করেছেন হিন্দুদের মত পৈতে এবং কালী ঠাকুরের পছন্দের লাল বসন। বিগত কয়েক বছর ধরে এই মুসলিম বাড়িতে কালীপূজার আয়োজনকে কেন্দ্র করে এলাকার লোকেদের মধ্যে একটা ভিন্ন ধরনের উন্মাদনা দেখা যায়।
 
কাসেম মিঞার বাড়িতে অনুষ্টিত কালিপুজোর একটি মুহূর্ত
 
কাসেম মিঞার পরিবার সহ আশপাশ এলাকার হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পরিবারের লোকজন এই পূজার প্রস্তুতিতে মেতে উঠেন। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। শুক্রবার সন্ধ্যায় কাসেম মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা তার ছোট্ট পরিসরের বাড়িতে রীতিমতো ভির লেগে আছে মানুষের। বাড়িতে একদিকে চলছে পূজার প্যান্ডেলের কাজ। অন্যদিকে তার চার চালা টিনের ঘরের বারান্দায় মায়ের ঠাকুর ঘরের সামনে আলপনা আঁকতে ব্যস্ত রয়েছেন প্রতিবেশী হিন্দু মহিলারা। চলছে মন্দিরে আলোকসজ্জার কাজ সহ পূজার অন্যান্য প্রস্তুতি।
 
যদিও আমাদের প্রতিনিধি গেলে ক্যামেরার সামনে এসে ইন্টারভিউ দিতে রাজি হননি কাসেম মিয়া। ক্যামেরার বাইরে থেকে তিনি তার এই ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন। কাসেম মিয়া জানান ২০১০ সালে তিনি স্বপ্নে প্রাপ্ত নির্দেশে মায়ের আরাধনা শুরু করেন। ত্রিপুরেশ্বরী মায়ের প্রতি তার এক ভিন্ন ধরনের আবেগপ্রবণ মানসিকতা এবং শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। তারপরই কাসেম মিয়া নিজের বন্ধু শোভন পালের সহায়তায় মায়ের মাটির মূর্তি তৈরি করেন। সেই মূর্তি নিজের ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন এবং শুরু হয় পূজার্চনা।
 
কাসেম মিয়া বলেন তিনি নিজেও জানেন না ঠিক কিভাবে মুসলিম ধর্মের লোক হয়েও ত্রিপুরেশ্বরী মায়ের প্রতি তার এই আঘাত ভক্তি তৈরি হল। কিন্তু এখন তিনি মাকেই (ত্রিপুরেশ্বরী কালি মাতা) নিজের জীবনের সবকিছু মনে করছেন এবং মায়ের ভক্তির জন্য নিজের সমস্ত কিছু ছাড়তে রাজি আছেন। তিনি আরো বলেন নির্দিষ্ট একটি ধর্মে জন্মগ্রহণ করে সেই ধর্মীয় রীতিনীতি ঊর্ধে উঠে অন্য কোন ধর্মের দেবদেবীর প্রতি আস্থা রেখে পূজার্চনা করার বিষয়টি ততটা সহজ ছিল না।
প্রথম দিকে তাকে এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের অনেক সামাজিক গ্লানি এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অনেকে তার এই ভক্তিকে বিকৃত করে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনাও করেছেন। কিন্তু সমস্ত রকম প্রতিকূলতার মধ্যে ও তিনি মায়ের পূজার্চনা ছাড়েননি। ক্রমশ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। তার ভক্তির সামনে হার মানে সমস্ত ধরনের প্রতিকূলতা। বর্তমান সময়ে এলাকার উভয় সম্প্রদায়ের লোক তার এই ভক্তিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এবং তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছেন।
 
কাসেম মিয়া বলেন এখন তার একমাত্র ইচ্ছা মায়ের জন্য একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এটা করতে গেলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন সেটা তার কাছে নেই। মায়ের আশীর্বাদে একদিন তিনি সেই লক্ষ্য পূরণ করবেন বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রয়েছেন। কাসেম মিয়া আরো বলেন বিগত কয়েক বছর যাবত তার বাড়ির এই পূজার অনুষ্ঠানে বহু সংখ্যক লোকের সমাগম হয়। অনেক নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক তার বাড়ির পূজাতে অংশগ্রহণ করেন।
 
এবারো তিনি নিজের বাড়িতে কালী পূজার অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ একাধিক মন্ত্রী বিধায়ককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সমাজকে বার্তা দিতে গিয়ে কাসেম মিয়া বলেন শ্রদ্ধা এবং ভক্তির কাছে ধর্ম কোনদিনই বাঁধা হতে পারে না। মানুষকে সেটা বুঝা উচিত। তিনি আরো বলেন তিনি কোনভাবেই নিজের ধর্ম পরিবর্তন করতে চাইছেন না তবে মুসলিম ধর্মের মধ্যে থেকেই তিনি কাল মায়ের প্রতি নিজের ভক্তি অক্ষুন্ন রাখতে চাইছেন।